পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ny 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী মহাত্মীজির পুণ্যব্ৰত যুগে যুগে দৈবাৎ এই সংসারে মহাপুরুষের আগমন হয়। সব সময় তাদের দেখা পাই নে। যখন পাই সে আমাদের সৌভাগ্য। আজকের দিনে দুঃখের অন্ত নেই ; কত পীড়ন, কত দৈন্য, কত রোগ শোক তাপ আমরা নিত্য ভোগ করছি ; দুঃখ জমে উঠেছে রাশি রাশি। তবু সব দুঃখকে ছাড়িয়ে গেছে আজ এক আনন্দ । যে মাটিতে আমরা বেঁচে আছি, সঞ্চারণ করছি, সেই মাটিতেই একজন মহাপুরুষ, যার তুলনা নেই, তিনি ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেছেন। যারা মহাপুরুষ তারা যখন আসেন, আমরা ভালো করে চিনতে পারি। নে তাদের। কেননা, আমাদের মন ভীরু অস্বচ্ছ, স্বভাব শিথিল, অভ্যাস দুর্বল। মনেতে সেই সহজ শক্তি নেই যাতে করে মহৎকে সম্পূর্ণ বুঝতে পারি, গ্ৰহণ করতে পারি। বারে বারে এমন ঘটেছে, যারা সকলের বড়ো তাদেরই সকলের চেয়ে দূরে ফেলে রেখেছি। যারা জ্ঞানী, গুণী, কঠোর তপস্বী, তাদের বোঝা সহজ নয় ; কেননা আমাদের জ্ঞান বুদ্ধি সংস্কার র্তাদের সঙ্গে মেলে না । কিন্তু একটা জিনিস বুঝতে কঠিন লাগে না, সেটা ভালোবাসা । যে মহাপুরুষ ভালোবাসা দিয়ে নিজের পরিচয় দেন, তাকে আমাদের ভালোবাসায় আমরা একরকম করে বুঝতে পারি। সেজন্যে ভারতবর্ষে এই এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল যে, এবার বুঝেছি। এমনটি সচরাচর ঘটে না । যিনি আমাদের মধ্যে এসেছেন তিনি অত্যন্ত উচ্চ, অত্যন্ত মহৎ । তবু তাকে স্বীকার করেছি, তাকে জেনেছি। সকলে বুঝেছে। “তিনি আমার । তার ভালোবাসায় উচ্চ-নীচের ভেদ নেই, মুর্থ-বিদ্বানের ভেদ নেই, ধনী-দরিদ্রের ভেদ নেই। তিনি বিতরণ করেছেন সকলের মধ্যে সমান ভাবে তার ভালোবাসা । তিনি বলেছেন, সকলের কল্যাণ হােক, সকলের মঙ্গল হােক। যা বলেছেন, শুধু কথায় নয় বলেছেন দুঃখের বেদনায়। কত পীড়া, কত অপমান তিনি সয়েছেন। তার জীবনের ইতিহাস দুঃখের ইতিহাস । দুঃখ অপমান ভোগ করেছেন কেবল ভারতবর্ষে নয়, দক্ষিণ-আফ্রিকায় কত মার তঁাকে মৃত্যুর ধারে এনে ফেলেছে। র্তার দুঃখ নিজের বিষয়সুখের জন্যে নয়, স্বার্থের জন্যে নয়, সকলের ভালোর জন্যে। এই-যে এত মাির খেয়েছেন, উলটে কিছু বলেন নি কখনো, রাগ করেন নি। সমস্ত আঘাত মাথা পেতে নিয়েছেন । শত্রুরা আশ্চর্য হয়ে গেছে। ধৈর্য দেখে, মহত্ত্ব দেখে । তার সংকল্প সিদ্ধ হল, কিন্তু জোর-জবরদস্তিতে নয়। ত্যাগের দ্বারা, দুঃখের দ্বারা, তপস্যার দ্বারা তিনি জয়ী হয়েছেন। সেই তিনি আজ ভারতবর্ষের দুঃখের বােঝা নিজের দুঃখের বেগে ঠেলবার জন্যে দেখা দিয়েছেন । তোমরা সকলে তাকে দেখেছি কি না জানি না। কারও কারও হয়তো তাকে দেখার সৌভাগ্য ঘটেছে। কিন্তু তাকে জােন সকলেই, সমস্ত ভারতবর্ষ তাকে জানে। সবাই জান, সমস্ত ভারতবর্ষ। কিরকম করে তাকে ভক্তি দিয়েছে ; একটি নাম দিয়েছে- মহাত্মা | আশ্চৰ্য, কেমন করে চিনলে | মহাত্মা অনেককেই বলা হয়, তার কোনো মানে নেই। কিন্তু এই মহাপুরুষকে যে মহাত্মা বলা হয়েছে, তার মানে আছে। যার আত্মা বড়ো, তিনিই মহাত্মা । যাদের আত্মা ছোটাে, বিষয়ে বদ্ধ, টাকাকড়ি ঘরসংসারের চিন্তায় যাদের মন আচ্ছন্ন, তারা দীনাত্মা। মহাত্মা তিনিই, সকলের সুখ দুঃখ যিনি আপনার করে নিয়েছেন, সকলের ভালোকে যিনি আপনার ভালো বলে জানেন । কেননা, সকলের হৃদয়ে তার স্থান, তার হৃদয়ে সকলের স্থান । আমাদের শাস্ত্ৰে ঈশ্বরকে বলে মহাত্মা, মর্তলোকে সেই দিব্য ভালোবাসা সেই প্রেমের ঐশ্বৰ্য দৈবাৎ মেলে। সেই প্রেম যার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে তাকে আমরা মােটের উপর এই বলে বুঝেছি যে, তিনি হৃদয় দিয়ে সকলকে ভালোবেসেছেন। কিন্তু সম্পূর্ণ বুঝতে পারি না, ভালো করে চিনতে একটু বাধা লাগে। বাকা হয়ে গেছে আমাদের মন । সত্যকে স্বীকার করতে ভীরুতা দ্বিধা সংশয় আমাদের জাগে । বিনা ক্লেশে যা মানতে পারি। তাই মানি, কঠিনটাকে সরিয়ে রেখে দিই এক পাশে । তার সকলের চেয়ে বড়ো সত্যটাকে নিতে পারলুম না । এইখানেই তাকে মারলুম। তিনি এসেছেন, ফিরে গেলেন, শেষ পর্যন্ত তাকে নিতে পারলুম না।