পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Rdbr রবীন্দ্র-রচনাবলী চতুর্দিকে বন্ধুরা রয়েছেন। মহাদেব, বল্লভভাই, রাজাগোপালাচারী, রাজেন্দ্ৰপ্ৰসাদ, ঐদের লক্ষ্য করলেম। শ্ৰীমতী কন্তুরীবাঈ এবং সরোজিনীকে দেখলেম । জওহরলালের পত্নী কমলাও ছিলেন । মহাত্মাজির স্বভাবতই শীর্ণ শরীর শীর্ণতম, কণ্ঠস্বর প্রায় শোনা যায় না। জঠরে অন্ন জমে উঠেছে, তাই মধ্যে মধ্যে সোডা মিশিয়ে জল খাওয়ানো হচ্ছে। ডাক্তারদের দায়িত্ব অতিমাত্রায় পৌচেছে। অথচ চিত্তশক্তির কিছুমাত্র হ্রাস হয় নি। চিন্তার ধারা প্রবহমান, চৈতন্য অপরিশ্রান্তু। প্রয়োপবেশনের পূর্ব হতেই কত দুরূহ। ভাবনা, কত জটিল আলোচনায় ঠাকে নিয়ত ব্যাপৃত হতে হয়েছে। সমুদ্রপরের রাজনৈতিকদের সঙ্গে পত্রব্যবহারে মনের উপর কঠোর ঘাত-প্রতিঘাত চলেছে। উপবাসকালে নানান দলের প্রবল দাবি তার অবস্থার প্রতি মমতা করে নি, তা সকলেই জানেন । কিন্তু মানসিক জীৰ্ণতার কোনো চিহ্নই তো নেই। তার চিন্তার স্বাভাবিক স্বচ্ছ প্ৰকাশধারায় আবিলতা ঘটে নি। শরীরের কৃচ্ছসাধনের মধ্য দিয়েও আত্মার অপরাজিত উদ্যমের এই মূর্তি দেখে আশ্চর্য হতে হল। কাছে না এলে এমন করে উপলব্ধি করতেম না, কত প্ৰচণ্ড শক্তি এই ক্ষীণদেহ পুরুষের। আজ ভারতবর্ষের কোটি প্রাণের মধ্যে পৌঁছল মৃত্যুর বেদীতল-শায়ী এই মহৎ প্রাণের বাণী । কোনাে বাধা তাকে ঠেকাতে পারল না— দূরত্বের বাধা, ইটকাঠ-পাথরের বাধা, প্রতিকুল পলিটিকসের বাধা। বহু শতাব্দীর জড়ত্বের বাধা আজ তার সামনে ধূলিসাৎ হল। মহাদেব বললেন, আমার জন্যে মহাত্মজি একান্তমনে অপেক্ষা করছিলেন। আমার উপস্থিতি দ্বারা রাষ্টিক সমস্যার মীমাংসা-সাধনে সাহায্য করতে পারি। এমন অভিজ্ঞতা আমার নেই। তাকে যে তৃপ্তি দিতে পেরেছি, এই আমার আনন্দ । সকলে ভিড় করে দাড়ালে তঁর পক্ষে কষ্টকর হবে মনে করে আমরা সরে গিয়ে বসলেম । দীর্ঘকাল অপেক্ষা করছি কখন খবর এসে পৌঁছবে। অপরাষ্ট্রের রৌদ্র আড় হয়ে পড়েছে ইটের প্রাচীরের উপর। এখানে ওখানে দু-চারজন শুভ্ৰ-খন্দর-পরিহিত পুরুষ নারী শান্ত ভাবে আলোচনা করছেন। লক্ষ্য করবার বিষয়, কারাগারের মধ্যে এই জনতা । কারও ব্যবহারে প্রশ্রয়জনিত শৈথিল্য নেই। চরিত্রশক্তি বিশ্বাস আনে, জেলের কর্তৃপক্ষ তাই শ্ৰদ্ধা করেই এঁদেরকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে মেলামেশা করতে দিতে পেরেছেন। এঁরা মহাত্মীজির প্রতিশ্রুতির প্রতিকূলে কোনাে সুযোগ গ্রহণ করেন নি। আত্মমর্যাদার দৃঢ়তা এবং অচাঞ্চল্য ঐদের মধ্যে পরিস্ফুট । " দেখলেই বোঝা যায়, ভারতের স্বরাজা-সাধনার যোগ্য সাধক ঐরা । অবশেষে জেলের কর্তৃপক্ষ গবর্মেন্টের ছাপ-মারা মোড়ক হাতে উপস্থিত হলেন। তার মুখেও আনন্দের আভাস পেলুম। মহাত্মজি গভীর ভাবে ধীরে ধীরে পড়তে লাগলেন। সরোজিনীকে বললেম, এখন ঔর চার পাশ থেকে সকলের সরে যাওয়া উচিত। মহাত্মজি পড়া শেষ করে বন্ধুদের ডাকলেন । শুনলেম, তিনি তাদের আলোচনা করে দেখতে বললেন । এবং নিজের তরফ থেকে জানালেন, কাগজটা ডাক্তার আম্বেদকরকে দেখানো দরকার ; তার সমর্থন পেলে তবেই তিনি নিশ্চিন্ত হবেন । বন্ধুরা এক পাশে দাঁড়িয়ে চিঠিখনি পড়লেন। আমাকেও দেখালেন। রাষ্ট্রবুদ্ধির রচনা সাবধানে লিখিত, সাবধানেই পড়তে হয়। বুঝলেম মহাত্মজির অভিপ্ৰায়ের বিরুদ্ধ নয়। পণ্ডিত হৃদয়নাথ কুঞ্জরুর পরে ভার দেওয়া হল চিঠিখানার বক্তব্য বিশ্লেষণ করে মহাত্মজিকে শোনাবেন । তার প্রাঞ্জল ব্যাখ্যায় মহাত্মজির মনে আর কোনাে সংশয় রইল না। প্রয়ােপবেশনের ব্ৰত উদযাপন হল। প্রাচীরের কাছে ছায়ায় মহাত্মজির শয্যা সরিয়ে আনা হল। চতুদিকে জেলের কম্বল বিছিয়ে সকলে * বসলেন। লেবুর রস প্রস্তুত করলেন শ্ৰীমতী কমলা নেহেরু। Inspector-General of Prisons- যিনি গবর্মেন্টের পত্র নিয়ে এসেছেন- অনুরোধ করলেন, রস যেন মহাত্মজিকে দেন শ্ৰীমতী কন্তুরীবাঈ নিজের হাতে। মহাদেব বললেন, “জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো গীতাঞ্জলির এই গানটি মহাত্মজির প্রিয়। সুর ভুলে গিয়েছিলেম। তখনকার মতো সুর দিয়ে গাইতে