পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SRSW) রবীন্দ্র-রচনাবলী জোগান দেওয়ার দ্বারা ছেলেদের মনটাকে আদুরে করে তোলা তাদের ক্ষতি করা। সহজেই তারা যে এত কিছু চায় তা নয়, তারা আত্মতৃপ্ত ; আমরাই বয়স্কলোকের চাওয়াটা কেবলই তাদের উপর চাপিয়ে তাদেরকে বস্তুর নেশা-গ্ৰস্ত করে তুলি। গোড়া থেকেই শিক্ষার প্রয়োজন এই কথা ভেবে যে, কত অল্প নিয়ে চলতে পারে। শরীর-মনের শক্তির সম্যকরূপে চৰ্চা সেইখানেই ভালো করে সম্ভব যেখানে বাইরের সহায়তা অনতিশয়। সেখানে মানুষের আপনার সৃষ্টি উদ্যম আপনি জাগে। যাদের না জাগে প্রকৃতি তাদেরকে আবর্জনার মতো বেঁটিয়ে ফেলে দেয়। আত্মকর্তৃত্বের প্রধান লক্ষণ সৃষ্টিকর্তৃত্ব । সেই মানুষই যথার্থ স্বরাট যে আপনার রাজ্য আপনি সৃষ্টি করে। আমাদের দেশের মেয়েদের হাতে অতিলালিত ছেলেরা মনুষোচিত সেই আত্মপ্রবর্তনার চর্চা থেকে প্রথম হতেই বঞ্চিত । তাই আমরা অন্যদের শক্ত হাতের চাপে অন্যদের ইচ্ছার নমুনায় রূপ নেবার জন্যে অত্যন্ত কাদামাখ্যাভাবে প্ৰস্তুত । তাই আপিসের নিম্নতম বিভাগে আমরা আদর্শ কর্মচারী । এই উপলক্ষে আর-একটা কথা আমার বলবার আছে। গ্ৰীষ্মপ্ৰধান দেশে শরীর-তন্তুর শৈথিল্যে বা অন্য যে কারণবশতই হােক আমাদের মানসপ্রকৃতিতে ঔৎসুক্যের অত্যন্ত অভাব। একবার আমেরিকা থেকে জল-তোলা বায়ুচক্ৰ আনিয়েছিলুম। প্রত্যাশা করেছিলুম। প্রকাণ্ড এই যন্ত্রটার ঘূৰ্ণিপাখার চালনা দেখতে ছেলেদের আগ্রহ হবে । কিন্তু দেখলুম। অতি অল্প ছেলেই ওটার দিকে ভালো করে তাকালো । ওরা নিতান্তই আলগাভাবে ধরে নিলে ও একটা জিনিস মাত্র । কেবল একজন নেপালী ছেলে ওটাকে মন দিয়ে দেখেছে। টিনের বাক্স কেটে সে ওর একটা নকলও বানিয়েছে। মানুষের প্রতি আমাদের ছেলেদের ঔৎসুক্য দুর্বল, গাছপালা পশুপাখির প্রতিও। স্রোতের শ্যাওলার মতাে ওদের মন ভেসে বেড়ায়, চার দিকের জগতে কোনো কিছুকেই আঁকড়ে ধরে না । নিরেীৎসুক্যই আন্তরিক নিজীবতা। আজকের দিনে যে-সব জাতি সমস্ত পৃথিবীর উপর প্রভাব বিস্তার করেছে সমস্ত পৃথিবীর সব কিছুরই উপরে তাদের ঔৎসুক্যের অন্ত নেই। কেবলমাত্র নিজের দেশের মানুষ ও বস্তু সম্বন্ধে নয়, এমন দেশ নেই এমন কাল নেই এমন বিষয় নেই যার প্রতি তাদের মন ধাবিত না হচ্ছে । মন তাদের সর্বতোভাবে বেঁচে আছে- তাদের এই সজীব চিত্তশক্তি জয়ী হল সর্বজগতে । পূর্বেই আভাস দিয়েছি আশ্রমের শিক্ষা পরিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকবার শিক্ষা। মরা মন নিয়েও পড়া মুখস্থ করে পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীর উর্ধশিখরে ওঠা যায় ; আমাদের দেশে প্রত্যহ তার পরিচয় পাই । তারাই আমাদের দেশের ভালো ছেলে যাদের মন গ্রন্থের পত্রিচর, ছাপার অক্ষরে একান্ত আসক্ত, বাইরের প্রত্যক্ষ জগতের প্রতি যাদের চিত্তবিক্ষেপের কোনো আশঙ্কা নেই। এরা পদবী অধিকার করে, জগৎ অধিকার করে না । প্রথম থেকে আমার সংকল্প এই ছিল, আমার আশ্রমের ছেলেরা চারিদিকের জগতের অব্যবহিত সম্পর্কে উৎসুক হয়ে থাকবে- সন্ধান করবে, পরীক্ষা করবে, সংগ্ৰহ করবে। অর্থাৎ এখানে এমন-সকল শিক্ষক সমবেত হবেন যাদের দৃষ্টি বইয়ের সীমানা পেরিয়ে গেছে, যারা চক্ষুষ্মান, যারা সন্ধানী, যারা বিশ্বকুতুহলী, যাদের আনন্দ প্রত্যক্ষ জ্ঞানে এবং সেই জ্ঞানের বিষয়বিস্তারে, র্যাদের প্রেরণাশক্তি সহযোগীমণ্ডল সৃষ্টি করে তুলতে পারে। সব শেষে বলব আমি যেটাকে সব চেয়ে বড়ো মনে করি এবং যেটা সব চেয়ে দুর্লভ। তঁরাই শিক্ষক হবার উপযুক্ত ধারা ধৈৰ্যবান, ছেলেদের প্রতি স্নেহ যাদের স্বাভাবিক। শিক্ষকদের নিজের চরিত্র সম্বন্ধে যথার্থ বিপদের কথা এই যে, যাদের সঙ্গে তাদের ব্যবহার, ক্ষমতায় তারা তাদের সমকক্ষ নয়। র্তাদের প্রতি সামান্য কারণে অসহিষ্ণু হওয়া এবং বিদ্রুপ করা অপমান করা শান্তি দেওয়া অনায়াসেই সম্ভব । যাকে বিচার করা যায়। তার যদি কোনোই শক্তি না থাকে। তবে অবিচার করাই সহজ হয়ে ওঠে। ক্ষমতা ব্যবহার করবার স্বাভাবিক যোগ্যতা যাদের নেই অক্ষমের প্রতি অবিচার করতে কেবল যে তাদের বাধা থাকে না তা নয়, তাদের আনন্দ থাকে। ছেলেরা অবোধ হয়ে দুর্বল হয়ে মায়ের কোলে আসে, এইজন্যে তাদের রক্ষার প্রধান উপায় মায়ের মনে অপৰ্যাপ্ত স্নেহ । তৎসত্ত্বেও স্বাভাবিক অসহিষ্ণুতা ও শক্তির অভিমান স্নেহকে অতিক্রম করেও ছেলেদের পরে অন্যায় অত্যাচারে