পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SVo রবীন্দ্ৰ-য়চনাবলী বলে স্বীকার করে না, বাধা বলেই স্বীকার করে। যা আছে তাই সত্য, যা প্রতীয়মান তাই প্ৰতীতির যোগ্য, মানুষ এ কথা বলে নি । পশুবৎ বর্বর মানুষের মধ্যে বাহ্যশক্তি যতই প্ৰবল থােক, তার সত্য যে ক্ষীণ অর্থাৎ তার প্রকাশ যে বাধাগ্রান্ত এ কথা মানুষ প্রথম থেকেই কোনোরকম করে উপলব্ধি করেছিল বলেই সে যাকে সভ্যতা বলে সে পদার্থটা তার কাছে নিরর্থক হয় নি । সভ্যতা-শব্দটার আসল মানে হচ্ছে, সভার মধ্যে আপনাকে পাওয়া, সকলের মধ্যে নিজেকে উপলব্ধি করা। সভা-শব্দের ধাতুগত অর্থ এই যে, যেখানে আভা যেখানে আলোক আছে। অর্থাৎ মানুষের প্রকাশের আলো একলা নিজের মধ্যে নয়, সকলের সঙ্গে মিলনে । যেখানে এই মিলনতত্ত্বের যতটুকু খর্বতা সেইখানেই মানুষের সত্য সেই পরিমাণেই আচ্ছন্ন । এইজন্যেই মানুষ কেবলই আপনাকে আপনি বলছে- “অপাবৃণু, খুলে ফেলো, তোমার একলা-আপনের ঢাকা খুলে ফেলো, তোমার সকল-আপনের সত্যে প্রকাশিত হও ; সেইখানেই তোমার দীপ্তি, সেইখানেই তোমার মুক্তি । বীজ যখন অন্ধুরীরূপে প্রকাশিত হয় তখন ত্যাগের দ্বারা হয়। সে ত্যাগ নিজেকেই ত্যাগ। সে আপনাকে বিদীর্ণ করে তবে আপনার সত্যকে মুক্তি দিতে পারে । তেমনি, যে আপন সকলের তাকে পাবার জন্যে মানুষেরাও ত্যাগ করতে হয় যে আপন তার একলার, তাকে । এইজন্যে ঈশোপনিষদ । বলেছেন, যে মানুষ আপনাকে সকলের মধ্যে ও সকলকে আপনার মধ্যে পায় ‘ন ততো বিজুগুসতে— সে আর গোপন থাকে না অসত্যে গোপন করে, সত্যে প্রকাশ করে । তাই আমাদের প্রার্থনা, ‘আসতো মা সদগময়- অসত্য থেকে আমাকে সত্যে নিয়ে যাও ; ‘আবিরাবীর্ম এধি- হে প্ৰকাশস্বরূপ, আমার মধ্যে তোমার আবির্ভাব হােক । তা হলে দেখা যাচ্ছে, প্ৰকাশ হচ্ছে আপনাকে দান। আপনাকে দিতে গিয়ে তবে আপনাকে প্ৰকাশ করি, আপনাকে জানতে পাই । আপনাকে দেওয়া এবং আপনাকে জানা একসঙ্গেই ঘটে । নির্বাপিত প্ৰদীপ আপনাকে দেয় না, তাই আপনাকে পায় না। যে মানুষ নিজেকে সঞ্চয় করে সকলের চেয়ে বড়ো হয় সেই প্রচ্ছন্ন, সেই অবরুদ্ধ ; যে মানুষ নিজেকে দান করে সকলের সঙ্গে এক হতে চায় সেই প্রকাশিত, সেই মুক্ত । সওগাদ, তার উপরে নানা রঙের চিত্র-করা রুমাল ঢাকা । যতক্ষণ রুমাল আছে ততক্ষণ দেওয়া হয় নি, ততক্ষণ সমস্ত জিনিসটা আমার নিজের দিকেই টানা । ততক্ষণ মনে হয়েছে, ঐ রুমালটাই মহামূল্য । ততক্ষণ আসল জিনিসের মানে পাওয়া গেল না, তার দাম বোঝা গেল না। যখন দান করবার সময় এল, রুমাল যখন খোলা গেল, তখনই আসলের সঙ্গে বিশ্বের পরিচয় হল, সব সার্থক হল । আমাদের আত্মনিবেদন যখন পূর্ণ হয় তখনই নিজেকে সম্পূর্ণ পাই। নইলে আমার আপনি-নামক যে বিচিত্র ঢাকাখানা আছে সেইটেই চরম বলে বোধ হয়, সেইটোকেই কোনোরকমে বাচাবার প্রাণপণ চেষ্টা মনে জগতে থাকে। সেইটে নিয়েই যত ঈর্ষা, যত ঝগড়া, যত দুঃখ । যারা মূঢ় তারা সেইটেরই রঙ দেখে ভুলে যায়। নিজের যেটা সত্য রূপ সেইটেই হচ্ছে বিশ্বের সঙ্গে মিলনের রূপ। আজ নববর্ষের দিন আমাদের আশ্রমের ভিতরকার সত্যকে প্ৰত্যক্ষ করবার দিন । যে তপস্যা এখানে স্থান পেয়েছে তার সৃষ্টিশক্তিটি কী তা আমাদের জানতে হবে । এর বাইরের একটা ব্যবস্থা আছে, এর ঘরবাড়ি তৈরি হচ্ছে, এর আইনকানুন চলছে, সে আমরা সকলে মিলে গড়ছি। কিন্তু এর নিজের ভিতরকার একটি তত্ত্ব আছে যা নিজেকে নিজে ক্রমশ উদঘাটিত করছে, এবং সেই নিয়ত উদঘাটিত করার প্রক্রিয়াই হচ্ছে তার সৃষ্টি । তাকে যদি আমরা স্পষ্ট করে দেখতে পাই তা হলেই আমাদের আত্মনিবেদনের উৎসাহ সম্পূর্ণ হতে পারে। সত্য যখন আমাদের কাছে অস্পষ্ট থাকে তখন আমাদের ত্যাগের ইচ্ছা বল পায় না । সত্য আমাদের ত্যাগ করতে আহবান করে । কেননা ত্যাগের দ্বারাই আমাদের আত্মপ্ৰকাশ হয় | আল্লামের মধেও গেই আহ্বান পরিস্ট হয় উঠেছে। সে আকারে আমরা বিশ্বভারী নাম 亚