পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ՀԳ:8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী গেছে। সে এমন কোনো সত্যের নাগাল পেয়েছে যা সর্বকালীন সর্বজনীন, যা তার সমন্ত প্রয়োজনকে পরিপূর্ণ করে অক্ষয়ভাবে উদ্যবৃত্ত থাকে। এই হচ্ছে তার বিজ্ঞান। এই বিজ্ঞানকে প্রকাশের দ্বারাই পৃথিবীতে সে আপনার অধিকার পেয়েছে। যদি কোনাে কারণে যুরোপের দৈহিক বিনাশও ঘটে। তবু এই সত্যের মূল্যে মানুষের ইতিহাসে তার স্থান কোনোদিন বিলুপ্ত হতে পারবে না। মানুষকে চিরদিনের মতো সে সম্পদশালী করে দিয়েছে, এই তার সকলের চেয়ে বড়ো গীেরব, এই তার অমরতা। অথচ এই যুরোপ যেখানে আপনার লোভকে সমস্ত মানুষের কল্যাণের চেয়ে বড়ো করেছে। সেখানেই তার অভাব প্ৰকাশ পায়, সেখানেই তার খর্বতা, তার বর্বরতা । তার একমাত্র কারণ এই যে, বিচ্ছিন্নভাবে কেবল আপনচুকুর মধ্যে মানুষের সত্য নেই- পশুধর্মেই সেই বিচ্ছিন্নতা ; বিনাশশীল দৈহিক প্ৰাণ ছাড়া যে পশুর আর কোনো প্ৰাণ নেই। যারা মহাপুরুষ তারা আপনার জীবনে সেই অনির্বাণ আলোককেই জ্বলেন, যার দ্বারা মানুষ নিজেকে সকলের মধ্যে উপলব্ধি করতে পারে। পশ্চিম-মহাদেশ তার পলিটিক্সের দ্বারা বৃহৎ পৃথিবীকে পর করে দিয়েছে, তার বিজ্ঞানের দ্বারা বৃহৎ পৃথিবীকে নিমন্ত্রণ করেছে। বৃহৎকালের মধ্যে ইতিহাসের উদার রূপ যদি আমরা দেখতে পাই তা হলে দেখব, আত্মম্ভরি পলিটিক্সের দিকে যুরোপের আত্মবিমাননা, সেখানে তার অন্ধকার ; বিজ্ঞানের দিকেই তার আলোক জ্বলেছে, সেখানেই তার যথার্থ আত্মপ্ৰকাশ ; কেননা বিজ্ঞান সত্য, আর সত্যই অমরত দান করে। বর্তমান যুগে বিজ্ঞানেই য়ুরোপকে সার্থকতা দিয়েছে, কেননা বিজ্ঞান বিশ্বকে প্রকাশ করে ; আর তার সর্বভূক ক্ষুধিত পলিটিক্স তার বিনাশকেই সৃষ্টি করছে, কেননা পলিটিক্সের শোণিতরিক্ত-উত্তেজনায় সে নিজেকে ছাড়া আর সমস্তকেই অস্পষ্ট ও ছোটাে করে দেখে ; সুতরাং সত্যকে খণ্ডিত করার দ্বারা অশান্তির চক্ৰবাত্যায় আত্মহত্যাকে আবর্তিত করে তোলে । আমরা অত্যন্ত ভুল করব যদি মনে করি, সীমাবিহীন অহমিকা -দ্বারা, জাত্যভিমানে আবিল ভেদবুদ্ধি -দ্বারাই যুরোপ বড়ো হয়েছে। এমন অসম্ভব কথা আর হতে পারে না । বস্তুত সত্যের জোরেই তার জয়যাত্রা, রিপুর আকর্ষণেই তার অধঃপতন- যে রিপুর প্রবর্তনায় আমরা আপনাকে সব দিতে চাই, বাহিরকে বঞ্চিত করি । এখন নিজের প্রতি আমাদের সকলের চেয়ে বড়ো প্রশ্ন এই যে, আমাদের কি দেবার জিনিস কিছু নেই। আমরা কি আকিঙ্কন্যের সেই চরম বর্বরতায় এসে ঠেকেছি। যার কেবল অভাবই আছে, ঐশ্বৰ্য নেই। বিশ্বসংসার আমাদের দ্বারে এসে অদ্ভুক্ত হয়ে ফিরলে কি আমাদের কোনো কল্যাণ হতে পারে । দুর্ভিক্ষের অন্ন আমাদের উৎপাদন করতে হবে না, এমন কথা আমি কখনোই বলি নৈ, কিন্তু ভাণ্ডারে যদি আমাদের অমৃত থাকে তার দায়িত্ব সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আমরা বাঁচতে পারব ? এই প্রশ্নের উত্তর যিনিই যেমন দিন-না, আমাদের মনে যে উত্তর এসেছে বিশ্বভারতীর কাজের ভিতর তারই পূর্ণ অভিব্যক্তি হতে থােক, এই আমাদের সাধনা । বিশ্বভারতী এই বেদমন্ত্রের দ্বারাই আপন পরিচয় দিতে চায়- “যত্র বিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম। যে আত্মীয়তা বিশ্বে বিস্তৃত হবার যোগ্য সেই আখীয়তার আসন এখানে আমরা পাতিব । সেই আসনে জীৰ্ণতা নেই, মলিনতা নেই, সংকীর্ণতা নেই! এই আসনে আমরা সবাইকে বসাতে চেয়েছি ; সে কাজ কি এখনই আরম্ভ হয় নি। অন্য দেশ থেকে যে-সকল মনীষী এখানে এসে পৌঁচেছেন, আমরা নিশ্চয় জানি তার হৃদয়ের ভিতরে আহবান অনুভব করেছেন। আমার সুহৃদবর্গ, যারা এই আশ্রমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত, তারা সকলেই জানেন, আমাদের দূরদেশের অতিথিরা এখানে ভারতবর্ষেরই আতিথ্য পেয়েছেন, পেয়ে গভীর তৃপ্তিলাভ করেছেন। এখান থেকে আমরা যে-কিছু পরিবেশন করছি তার প্রমাণ সেই অতিথিদের কাছেই । তারা আমাদের অভিনন্দন করেছেন । আমাদের দেশের পক্ষ থেকে তারা আত্মীয়তা । পেয়েছেন, তাদের পক্ষ থেকেও আত্মীয়তার সম্বন্ধ সত্য হয়েছে। আমি তাই বলছি, কাজ আরম্ভ হয়েছে। বিশ্বভারতীর যে সত্য তা ক্রমশ উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে | এখানে আমরা ছাত্রদের কোন বিষয় পড়াচ্ছি, পড়ানো সকলের মনের মতো হচ্ছে কি না, সাধারণ কলেজের আদর্শে উচ্চশিক্ষা-বিভাগ খোলা হয়েছে বা জ্ঞানানুসন্ধান-বিভাগে কিছু কাজ হচ্ছে