পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিশ্বভারতী Rbra আনন্দ ছিল। কিন্তু মানুষ শুধু কবি নয়। বিশ্বলোকে চিত্তবৃত্তির যে বিচিত্র প্রবর্তনা আছে তাতে সাড়া । দিতে হবে সকল দিক থেকে ; বলতে হবে। ওঁ- আমি জেগে আছি । এখানে এলুম। যখন তখন আমার কর্মচেষ্টায় বাইরের প্রকাশ অতি দীন ছিল। সে সম্বন্ধে এইটুকুমাত্রই বলতে পারি, সেই উপকরণবিরল অতি ছোটাে ক্ষেত্রের মধ্যে আপনাকে দেওয়ার দ্বারা ও আপনাকে পাওয়ার দ্বারা যে আনন্দ তারই মধ্য দিয়ে এই আশ্রমের কাজ শুরু হয়েছে। দিনে দিনে এই কাজের ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে। আজ সে উদঘাটিত হয়েছে সর্বসাধারণের দৃষ্টির সামনে । আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি, আমাদের দেশের দৃষ্টি প্রায়ই অনুকুল নয়। কিন্তু তাতে ক্ষতি হয় নি, তাতে কর্মের মূল্যই বেড়েছে। ধারা সংকীর্ণ কর্তব্যসীমার মধ্যেও এই বিদ্যায়তনে কাজ করেছেন তাদেরও সহযোগিতা শ্ৰদ্ধার সঙ্গে সকৃতজ্ঞ চিত্তে আমার স্বীকার্য। এখানে ধারা এসেছেন তারা একে সম্পূর্ণভাবে গ্ৰহণ করেছেন কি না জানি না । কিন্তু তাদের উদ্দেশে এই প্ৰতিষ্ঠানকে আমি সমৰ্পণ করেছি। বহুদিন এই আশ্রমে আমরা প্রচ্ছন্ন ছিলাম। মাটির ভিতরে বীজের যে অজ্ঞাতবাস প্রাণের ফুরণের জন্য তার প্রয়োজন আছে। এই অজ্ঞাতবাসের পর্ব দীর্ঘকাল চলেছিল। আজ যদি এই প্ৰতিষ্ঠান লোকচক্ষুর গোচর হয়ে থাকে। তবে সেই প্রকাশ্য দৃষ্টিপাতের ঘাতসংঘাত ভালোমন্দ লাভক্ষতি সমস্ত স্বীকার করে নিতে হবে- কখনো পীড়িত মনে, কখনো উৎসাহের সঙ্গে । ধারা উপদেষ্টা পরামর্শদাতা বা অতিথি ভাবে এখানে আসেন তাদের জানিয়ে রাখি, আমাদের এই বিদ্যায়তনে ব্যবসায় বুদ্ধি নেই। এখানে ক্ষণে ক্ষণে উত্তেজিত জনমতের অনুবর্তন করে জনতার মন রক্ষা করি নি, এবং সেই কারণে যদি আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকি তবে সে আমাদের সৌভাগ্য। আমরা কর্মপ্রচেষ্টার মধ্যে শ্রেয়কে বরণ করবার প্রয়াস রাখি। কর্মের সাধনাকে মনুষ্যত্বসাধনার সঙ্গে এক বলে জানি । আমাদের এখানে সাধনার আসন পাতা রয়েছে । সকল স্থলেই যে সেই আসন সাধকেরা অধিকার করেছেন এমন গর্ব করি নে ! কিন্তু এখানকার আবহাওয়ার মধ্যে একটি আহবান আছে- আয়ন্ত সর্বতঃ স্বাহা । আমাদের মনে বিশ্বাস হয়েছে, আমাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয় নি, যদিও ফসলের পূর্ণপরিণত রূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। ধারা আমাদের সুদীর্ঘ এবং দুরূহ প্ৰয়াসের মধ্যে এমন কিছু দেখতে পেয়েছেন যার সৰ্বকালীন মূল্য আছে, ঠাদের সেই অনুকূল দৃষ্টি থেকে আমরা বর লাভ করেছি। তাদের দৃষ্টির সেই আবিষ্কার শক্তি জাগিয়েছে আমাদের কর্মে। দূরের থেকে এসেছেন মনীষীরা অতিথিরা, ফিরেছেন বন্ধুরূপে, তাদের আশ্বাস ও আনন্দ সঞ্চিত হয়েছে আশ্রমের সম্পদভাণ্ডারে । বহুদিনের ত্যাগের দ্বারা, চেষ্টার দ্বারা এই আশ্রমকে দেশের বেদীমূলে স্থাপন করবার জন্য নৈবেদ্যসংরচনকাৰ্য আমার আয়ুর সঙ্গে সঙ্গেই একরকম শেষ করে এনেছি। দূরের অতিথি-অভ্যাগতদের অনুমোদনের দ্বারা আমাদের কাছে এই কথা স্পষ্ট হয়েছে যে, এখানে প্রাণশক্তি রয়েছে। ফুলে ফলে বাইরের ফসলের কিছু-একটা প্রকাশ ঐরা দেখেছেন, তা ছাড়া তারা এর অন্তরের ক্রিয়াকেও দেখেছেন। দূরের সেই অতিথিরা মনীষীরা আমাদের পরম বন্ধু, কারণ তাদের আশ্বাস আমরা পেয়েছি। আমাদের এই আশ্রমের কর্মেত আমি যে আপনাকে সমর্পণ করেছি তা সার্থক হবে যদি আমার এই সৃষ্টি আমি যাবার পূর্বে দেশকে সঁপে দিতে পারি। শ্ৰদ্ধয়া দেয়মযেমন, তেমনি শ্ৰদ্ধয়া আদেয়াম। যেমন শ্ৰদ্ধায় দিতে চাই, তেমনি শ্ৰদ্ধায় একে গ্ৰহণ করতে হবে । এই দেওয়া-নেওয়া যেদিন পূর্ণ হবে সেদিন আমার সারা জীবনের কর্মসাধনার এই ক্ষেত্র পূর্ণতার রূপ লাভ করবে। v CMR bese Ryvese শান্তিনিকেতন