পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\OOO রবীন্দ্র-রচনাবলী পারত মা । তঁরা নিশ্চয় জানতেন মৃত্যু ভয়ের বিষয় নয়। মৃত্যুতে এই শরীরটা মাত্র যায়, কিন্তু অন্তরের জিনিস যায় না । তারা ধ্যান করতেন এবং যাতে ভালো হয়। সেইটে তারা ব্যবস্থা করতেন। কার কী করা উচিত সেইটে সকলে তাদের কাছে জানতে আসত। কিসে ঘরের লোকের মঙ্গল হয় তাই জানিবার জন্য গৃহস্থ লোকেরা তাদের কাছে আসত- কিসে প্রজাদের ভালো হয় তাই পরামর্শ নেবার জন্যে রাজারা তাদের কাছে আসত। পৃথিবীর সকলের ভালোর জন্য তঁরা সমস্ত আমোদ-প্রমোদ সমস্ত বিলাসিতা ত্যাগ করে চিন্তা করতেন । কিন্তু তখন কি কেবল ব্ৰাহ্মণ-ঋষিরাই ছিলেন । তা নয় । রাজারাও ছিলেন, রাজার সৈন্যসামন্ত ছিল। রাজ্যের প্রয়োজনে তাদের যুদ্ধবিগ্রহ করতে হত । কিন্তু যুদ্ধের সময়েও তারা ধর্ম ভুলতেন না । যে-লোকের হাতে অস্ত্র নেই তাকে মারতেন না, শরণাপন্নকে বধ করতেন না, রথের উপর চড়ে নীচের লোকদের উপর অস্ত্ৰ চালাতেন না । সৈন্যে-সৈন্যেই যুদ্ধ চলত, কিন্তু শত্রুপক্ষের দেশের নিরীহ প্রজাদের ঘরদুয়োর জ্বালিয়ে দিতেন না। রাজার ছেলের যখন বড়ো বয়স হত তখন রাজা আপনার সমস্ত টাকাকড়ি রাজত্ব ছেলের হাতে দিয়ে সত্য জানিবার জন্য, ঈশ্বরের প্রতি সমস্ত মন দেবার জন্যে বনে চলে যেতেন । তখন আর তাদের হীরা-মুক্তো ছাতা-জুতো লোকজন কিছুই থাকত না । রাজ্যেশ্বর রাজা ভিক্ষাপাত্ৰ হাতে নিয়ে দীনহীনের মতো সমস্ত ছেড়ে যেতেন । তারা জানতেন রাজ্য টাকাকড়ি বাইরের জিনিস, তাতেই যে মানুষ বড়ো হয় তা নয়, বড়ো হবার জিনিস ভিতরে। তবে ধর্মনিয়মমতে রাজত্ব করা রাজার কর্তব্য, সুতরাং সেজন্যে প্ৰাণ দেওয়া দরকার হলে তাও দিতেন- কিন্তু যুবরাজ বড়ো হয়ে উঠলে যখন সে কর্তব্যের শেষ হয় তখন আর তারা রাজত্ব আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকতেন न् । গৃহস্থদেরও ঐরকম নিয়ম ছিল। যখন জ্যেষ্ঠ পুত্র বড়ো হয়ে উঠত। তখন তারই হাতে সমস্ত সংসার দিয়ে তারা দরিদ্র বেশে তপস্যা করতে চলে যেতেন । যতদিন সংসারে থাকতে হত। ততদিন প্ৰাণপণে তার সংসারের কাজ করতেন ! আত্মীয় স্বজন প্রতিবেশী অতিথি অভ্যাগত দরিদ্র অনাথ কাউকেই ভুলতেন না- প্ৰাণপণে নিজের সুখ নিজের স্বাৰ্থ দূরে রেখে তাদেরই সেবা করতেন- তার পরে সময় উত্তীর্ণ হলেই আর ধনসম্পদ ঘরদুয়ারের প্রতি তাকতেন না । তখন যারা বাণিজ্য করতেন তাদেরও ধর্মপথে সত্যপথে চলতে হত । কাউকে ঠকানো, অন্যায় সুন্দ নেওয়া, কৃপণের মতো সমস্ত ধন কেবল নিজের জন্যেই জড়ো করে রাখা, এ তাদের দ্বারা হত না । যারা রাজত্ব করতেন, ধারা বাণিজ্য করতেন, ধারা কর্ম করতেন, তাদের সকলের জন্যই ব্ৰাহ্মাণের চিন্তা করতেন ; যাতে সমাজে ধর্ম থাকে, সত্য থাকে, শৃঙ্খলা থাকে, যাতে ভালো হয়, এই তাদের একান্ত লক্ষ্য ছিল । সেইজন্য তাদের আদর্শে তাদের উপদেশে তখনকার সকল লোকেই ভালো হয়ে চলতে পারত ; সমস্ত সমাজের মধ্যে সেইজন্যে এত উন্নতি এত শ্ৰী ছিল । সেই তখনকার ব্রাহ্মণ ক্ষত্ৰিয় বৈশ্যের যে-শিক্ষা যে-ব্রত অবলম্বন করে বড়ো হয়ে উঠেছিলেন, বীর হয়ে উঠেছিলেন, সেই শিক্ষা সেই ব্ৰত গ্ৰহণ করবার জন্যেই তোমাদের এই নির্জন আশ্রমের মধ্যে আমি আহবান করেছি! তোমরা আমার কাছে এসেছ- আমি সেই প্রাচীন ঋষিদের সত্যবাক্য ঠাদের উজ্বল চরিত মনের মধ্যে সর্বদা ধারণ করে রেখে তোমাদের সেই মহাপুরুষদের পথে চালনা করতে চেষ্টা করব৷-- আমাদের ব্ৰতপতি ঈশ্বর আমাকে সেই বল সেই ক্ষমতা প্ৰদান করুন । যদি আমাদের চেষ্টা সফল হয় তবে তোমরা প্রত্যেকে বীরপুরুষ হয়ে উঠবে- তোমরা ভয়ে কাতর হবে না, দুঃখে৷ বিচলিত হবে না, ক্ষতিতে ত্ৰিয়মাণ হবে না, ধনের গর্বে স্ফীত হবে না ; মৃত্যুকে গ্রাহ্য করবে না, সত্যকে জানতে চাইবে, মিথ্যাকে মন থেকে কথা থেকে কাজ থেকে দূর করে দেবে, সর্বদা জগতের সকল স্থানেই মনে এবং বাইরে এক ঈশ্বর আছেন এইটে নিশ্চয় জেনে আনন্দমনে সকল দুকর্ম থেকে নিবৃত্ত থাকবে। কর্তব্যকর্ম প্ৰাণপণে করবে, সংসারের উন্নতি ধর্মপথে থেকে করবে, অথচ যখন