পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Oo রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী প্ৰথম কাৰ্যপ্ৰণালী বিনয়সম্ভাষণমেতৎআপনার প্রতি আমি যে ভার অৰ্পণ করিয়াছি আপনি তাহ ব্ৰতস্বরূপে গ্ৰহণ করিতে উদ্যত হইয়াছেন, ইহাতে আমি বড়ো আনন্দলাভ করিয়াছি। একান্তমনে কামনা করি, ঈশ্বর আপনাকে এই ব্ৰতপালনের বল ও নিষ্ঠা দান করুন । আমি আপনাকে পূর্বেই বলিয়াছি, বালকদিগের অধ্যয়নের কাল একটি ব্ৰত্যযাপনের কাল। মনষ্যত্বলাভ স্বাৰ্থ নহে, পরমাৰ্থ- ইহা আমাদের পিতামহেরা জানিতেন । এই মনুষ্যত্ব লাভের ভিত্তি যে শিক্ষা তাহাকে তাহারা ব্ৰহ্মচর্যব্ৰত বলিতেন । এ কেবল পড়া মুখস্থ করা এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া নহে— সংযমের দ্বারা, ভক্তিশ্রদ্ধার দ্বারা, শুচিতা দ্বারা, একাগ্ৰ নিষ্ঠা দ্বারা সংসারাশ্রমের জন্য এবং সংসারাশ্রমের অতীত ব্ৰহ্মের সহিত অনন্ত যোগ সাধনের জন্য প্ৰস্তুত হইবার সাধনাই ব্ৰহ্মচৰ্যব্ৰত । ইহা ধৰ্মব্রত । পৃথিবীতে অনেক জিনিসই কেনাবেচার সামগ্ৰী বটে, কিন্তু ধর্ম পণ্যদ্রব্য নহে। ইহা এক পক্ষে মঙ্গল ইচ্ছার সহিত দান ও অপর পক্ষে বিনীত ভক্তির সহিত গ্ৰহণ করিতে হয়। এইজন্য প্রাচীন ভারতে শিক্ষা পণ্যদ্রব্য ছিল না । এখন যাহারা শিক্ষা দেন তাহারা শিক্ষক, তখন যাহারা শিক্ষা দিতেন তাহারা গুরু ছিলেন । তাহারা শিক্ষার সঙ্গে এমন একটি জিনিস দিতেন যাহা গুরুশিব্যের আধ্যাত্মিক সম্বন্ধ ব্যতীত দানপ্ৰতিগ্ৰহ হইতেই পারে না । ছাত্রদিগের সহিত এইরূপ পারমার্থিক সম্বন্ধ স্থাপনই শান্তিনিকেতন ব্ৰহ্মবিদ্যালয়ের মুখ্য উদ্দেশ্য। কিন্তু এ কথা মনে রাখা আবশ্যক যে, উদ্দেশ্য যত উচ্চ হইবে তাহার উপায়ও তত দুরূহ ও দুর্লভ হইবে । এ-সব কাৰ্য ফরমাসমত চলে না । শিক্ষক পাওয়া যায়, শুরু সহজে পাওয়া যায় না । এইজন্য যথাসম্ভব। লক্ষোর প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া ধৈৰ্য্যের সহিত সুযোগের প্রতীক্ষা করিতে হয় । সমস্ত অবস্থা বিবেচনায় যতটা মঙ্গলসাধন সম্ভবপর তাহাঁই শিরোধাৰ্য করিয়া লইতে হইবে এবং নিজের অযোগ্যতা স্মরণ করিয়া নিজেকে প্রত্যহ সাধনার পথে অগ্রসর করিতে হইবে। মঙ্গলব্রত গ্ৰহণ করিলে বাধাবিরোধ-অশান্তির জন্য মনকে প্ৰস্তুত করিতে হয়- অনেক অন্যায় আঘাতও ধৈৰ্য্যের সহিত সহ্য করিতে হইবে। সহিষ্ণুতা ক্ষমা ও কল্যাণভাবের দ্বারা সমস্ত বিরোধ-বিপ্লবকে জয় করিতে হইবে । ব্ৰহ্মবিদ্যালয়ের ছাত্রগণকে স্বদেশের প্রতি বিশেষরূপে ভক্তিশ্রদ্ধাবান করিতে চাই । পিতামাতায় যেরূপ দেবতার বিশেষ আবির্ভাব আছে- তেমনি আমাদের পক্ষে আমাদের স্বদেশে, আমাদের পিতৃপিতামহদিগের জন্ম ও শিক্ষা-স্থানে দেবতার বিশেষ সত্তা আছে । পিতামাতা যেমন দেবতা তেমনি স্বদেশও দেবতা। স্বদেশকে লঘূচিত্তে অবজ্ঞা, উপহাস, ঘৃণা এমন-কি, অন্যান্য দেশের তুলনায় ছাত্ররা যাহাতে খর্ব করিতে না শেখে সে দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখিতে চাই। আমাদের স্বদেশীয় প্রকৃতির বিরুদ্ধে চলিয়া আমরা কখনো সার্থকতা লাভ করিতে পারিব না । আমাদের দেশের যে বিশেষ মহত্ত্ব ছিল সেই মহত্ত্বের মধ্যে নিজের প্রকৃতিকে পূর্ণতা দান করিতে পারলেই আমরা যথার্থভাবে বিশ্বজনীনতার মধ্যে উত্তীর্ণ হইতে পারিব- নিজেকে ধ্বংস করিয়া অন্যের সহিত মিলাইয়া দিয়া কিছুই হইতে পারিব না- অতএব, বরঞ্চ অতিরিক্তমাত্রায় স্বদেশাচারের অনুগত হওয়া ভালো তথাপি মুগ্ধভাবে বিদেশীর অনুকরণ করিয়া নিজেকে কৃতাৰ্থ মনে করা কিছু নহে। ব্ৰহ্মচর্য-ব্ৰতে ছাত্রদিগকে কাঠিন্য অভ্যাস করিতে হইবে । বিলাস ও ধনাভিমান পরিত্যাগ করিতে হইবে । ছাত্রদের মন হইতে ধনের গীেরব একেবারে বিলুপ্ত করিতে চাই। যেখানে তাহার কোনো লক্ষণ দেখা যাইবে সেখানে তাহা একেবারে নষ্ট করা কর্তব্য হইবে। আমার মনে হইয়াছে’-র পুত্র-র শৌখিন দ্রব্যের প্রতি কিঞ্চিৎ আসক্তি আছে- সেটা দমন করিতে হইবে। বেশভূষা সম্বন্ধে বিলাসিতা পরিত্যাগ করিতে হইবে। কেহ দারিদ্র্যকে যেন লজ্জাজনক ঘূণাজনক না মনে করে। অৰ্শনে বসনেও