পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VVr রবীন্দ্র-রচনাবলী মানুষের প্রতাপ ও ঐশ্বৰ্য যখন চােখে দেখিতে পাই তখন আমাদের মনের উপর তাহার প্রভাব যে কিরূপ প্রবল হইয়া উঠে তাহা বর্তমান যুগে আমরা স্পষ্টই দেখিতে পাইতেছি। সে আপনার চেয়ে বড়ো যেন আর কাহাকেও স্বীকার করিতে চায় না। মানুষ এই ঐশ্বর্যের প্রলোভনে আকৃষ্ট হইয়া কেহ বা ভিক্ষাবৃত্তি, কেহ-বা দাস্যবৃত্তি, কেহ-বা দস্যবৃত্তি অবলম্বন করিয়া সমস্ত জীবন কাটাইয়া দেয়- এক মুহূর্ত অবকাশ পায় না । যিশু যখন জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন তখন রোম-সাম্রাজ্যের প্রতাপ অভ্ৰভেদী হইয়া উঠিয়াছিল । যে কেহ যে দিকে চোখ মেলিত এই সাম্রাজ্যেরই গৌরবচুড়া সকল দিক হইতেই চোখে পড়িতে থাকিত ; ইহারই আয়োজন উপকরণ সকলের চিত্তকে অভিভূত করিয়া দিতেছিল। রোমের বিদ্যাবুদ্ধি বাহুবল ও রাষ্ট্রীয় শক্তির মহাজালে যখন বিপুল সাম্রাজ্য চারি দিকে আবদ্ধ, সেই সময়ে সাম্রাজ্যের এক প্রান্তে দরিদ্র ইহুদি মাতার গর্ভে এই শিশু জন্মগ্রহণ করিলেন । তখন রোম-সাম্রাজ্যে ঐশ্বর্যের যেমন প্রবল মূর্তি, ইহুদিসমাজে লোকাচার ও শাস্ত্রশাসনেরও সেইরূপ প্ৰবল প্রভাব । *ն ইহুদিদের ধর্ম স্বজাতির মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ । তাহদের ঈশ্বর জিহােভা বিশেষভাবে তাহাদিগকে বরণ করিয়া লইয়াছেন এইরূপ তাহাদের বিশ্বাস । তাহার নিকট তাহারা কতকগুলি সত্যে বদ্ধ, এই সত্যগুলি বিধিরূপে তাহদের সংহিতায় লিখিত । এই বিধি পালন করাই ঈশ্বরের আদেশ-পালন । বিধির অচল গণ্ডির মধ্যে নিয়ত বাস করিতে গেলে মানুষের ধর্মবুদ্ধি কঠিন ও সংকীর্ণ না হইয়া থাকিতে পারে না । কিন্তু ইহুদিদের সনাতন-আচার-নিষ্পেষিত চিত্তে নূতন প্ৰাণ সঞ্চার করিবার উপায় ঘটিয়াছিল । মাঝে মাঝে তাহাদের পাথরের প্রাচীর ভেদ করিয়া তাহদের মধ্যে এক-একজন ঋষি আসিয়া দেখা দিতেন। ধর্মের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি বহন করিয়াই তাঁহাদের অভু্যদয় । তাহারা স্মৃতিশাস্ত্রের মৃতপত্ৰ-মৰ্মরকে আচ্ছন্ন করিয়া দিয়া অমৃতবাণী প্রচার করিতেন। এই ইসায়া জেরোমায়া প্রভৃতি ইহুদি ঋষিগণ পরমদুৰ্গতির দিনে আলোক জ্বালাইয়াছেন, তাহাদের তীব্ৰ জ্বালাময় বাক্যের বাজুবর্ষণে স্বজাতির বদ্ধ জীবনের বহুদিনসঞ্চিত কলুষরাশি দগ্ধ করিয়াছেন । , শাস্ত্র ও আচারধর্মের দ্বারাই ইহুদিদের সমস্ত জীবন নিয়মিত । যদিচ তাহারা সাহসিক যোদ্ধা ছিল, তবু রাষ্ট্ররক্ষা-ব্যাপারে তাহাদের পটুত্ব প্রকাশ পায় নাই। এইজন্য রাষ্ট্র সম্বন্ধে বিদেশী প্রতিবেশীদের হাতে তাহারা দুৰ্গতিলাভ করিয়াছিল। যিশুর জন্মের কিছুকাল পূর্ব হইতে ইহুদিদের সমাজে ঋষি-অভু্যদয় বন্ধ ছিল। কালের গতি প্রতিহত করিয়া, প্রাণের প্রবাহ অবরুদ্ধ করিয়া, পুরাতনকে চিরস্থায়ী করিবার চেষ্টায় তখন সকলে নিযুক্ত ছিল । বাহিরকে একেবারে বাহিরে ঠেকাইয়া, সমস্ত দ্বার জানালা বন্ধ করিয়া, দেয়াল গাথিয়া তুলিবার দলই তখন প্রবল হইয়া উঠিয়ছিল। নবসংকলিত তালমদ শাস্ত্ৰে বাহ্য আচারবন্ধনের আয়োজন পাকা হইল, এবং ধর্মপালনের মূলে যে-একটি মুক্ত বুদ্ধি ও স্বাধীনতা-তত্ত্ব আছে তাহাকে স্থান দেওয়া হইল না । জড়ত্বের চাপ যতই কঠোর হউক মনুষ্যত্বের বীজ একেবারে মরিতে চায় না। অন্তরাত্মা যখন পীড়িত হইয়া উঠে, বাহিরে যখন সে কোনো আশার মূর্তি দেখিতে পায় না, তখন তাহার অন্তর হইতেই আশ্বাসের বাণী উচ্ছসিত হইয়া উঠে— সেই বাণীকে সে হয়তো সম্পূর্ণ বােঝে না, অথচ তাহাকে প্রচার করিতে থাকে । এই সময়টাতে ইহুদিরা আপনা-আপনি বলাবলি করিতেছিল, মর্তে পুনরায় স্বৰ্গরাজ্য প্রতিষ্ঠার কাল আসিতেছে। তাহারা মনে করিতেছিল, তাহাদেরই দেবতা তাহাদের জাতিকেই এই স্বৰ্গরাজ্যের অধিকার দান করিবেন- ঈশ্বরের বরপুত্র ইহুদি জাতির সত্যযুগ পুনরায় আসন্ন হইয়াছে । এই আসন্ন শুভ মুহুর্তের জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে এই ভাবটিও জাতির মধ্যে কাজ করিতেছিল। এইজন্য মরুস্থলীতে বসিয়া অভিষেকদাতা যোহন যখন ইহুদিদিগকে অনুতাপের দ্বারা পাপের প্ৰায়শ্চিত্ত ও জর্ডনের তীৰ্থজলে দীক্ষা গ্ৰহণ করিবার জন্য আহবান করিলেন তখন দলে দলে