পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VV8 রবীন্দ্র-রচনাবলী শহরগুলি লোকালয়ের বিশেষ বিশেষ প্রয়োজনসাধনের কেন্দ্র, মানুষের উদ্যম এক এক স্থানে বিশেষ লক্ষ্য নিয়ে সংহত হয়ে তাদের সৃষ্টি করেছে। পূর্বকালে ধন সৃষ্টি প্রভৃতির প্রয়োজন-সাধনে যন্ত্রের হাত ছিল অতি সামান্যই। তখনকার যন্ত্রগুলির সঙ্গে মানুষের শরীর-মনের যোগ সর্বক্ষণ অব্যবহিত ছিল। সেইজন্যে তার থেকে যা উৎপন্ন হতে পারত তা ছিল পরিমিত, আর তার মুনাফা বিকট প্ৰকাণ্ড ছিল না। সুতরাং তখন পণ্যরচনায় কর্মশক্তির আনন্দটা ছিল প্রধান, কর্মফলেরঙ্গলৈাভটা তার চেয়ে খুব বড়ো হয়ে ওঠেনি। তাই তখনকার নগরগুলি মানুষের কীর্তির আনন্দরূপ গ্ৰহণ করতে পারত । অন্যান্য সকল রিপুর মতোই লোভটা সমাজবিরোধী প্রবৃত্তি। এইজন্যেই মানুষ তাকে রিপু বলেছে। বাইরে থেকে ডাকাত যেমন লোকালয়ের রিপু, ভিতর থেকে লোভটা তেমনি । যতক্ষণ এই রিপু পরিমিত থাকে ততক্ষণ এতে করে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কর্মেদ্যম বাড়িয়ে তোলে, অথচ সমাজনীতিকে সেটা ছাপিয়ে যায় না । কিন্তু লোভের কারণটা যদি অত্যন্ত প্ৰবল ও তার চরিতার্থতার উপায় অত্যন্ত বিপুল শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তবে সমাজনীতি আর তাকে সহজে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। আধুনিক কালে যন্ত্রের সহযোগে কর্মের শক্তি যেমন বহুগুণিত, তেমনি তার লাভ বহু অঙ্কের, আর সেই সঙ্গে সঙ্গে তার লোভ । এতে করেই ব্যক্তিস্বার্থের সঙ্গে সমাজস্বার্থের সামঞ্জস্য টলমল করে উঠছে। দেখতে দেখতে চারি দিকে কেবল লড়াই ব্যাপ্ত হয়ে চলেছে। এইরকম অবস্থায় গ্রামের সঙ্গে শহরের একান্নবর্তিতা চলে যায়, শহর গ্রামকে কেবল শোষণ করে, কিছু ফিরিয়ে দেয় না। আজ গ্রামের আলো নিবল ! শহরে কৃত্রিম আলো জ্বলল- সে আলোয় সূর্য চন্দ্ৰ নক্ষত্রের সংগীত নেই। প্রতি সূর্যোদয়ে যে প্ৰণতি ছিল, সূর্যাস্তে যে আরতির প্রদীপ জ্বলত, সে আজ লুপ্ত, স্নান । শুধু যে জলাশয়ের জল শুকোলো তা নয়, হৃদয় শুকোলো। জীবনের আনন্দে মাঠের ফুলের মতো যে-সব নৃত্যগীত আপনি জেগে উঠত তারা জীৰ্ণ হয়ে ধূলায় মিলিয়ে গেল। প্ৰাণের ঔদার্য এতকাল আপনিই আপনার সহজ আনন্দের সুন্দর উপকরণ আপনিই সৃষ্টি করেছে— আজ সে গেল বোবা হয়ে, অসাড় হযে যাচ্ছে । বেশি দিনের কথা নয়, নবাবি আমলে দেখা গেছে, তখনকার বড়ো বড়ো আমলা র্যারা রাজদরবারে রাজধানীতে পুষ্ট, জন্মগ্রামের সমাজ-রন্ধনকে তঁরা অনুরাগের সঙ্গে স্বীকার করেছেন। তারা অর্জন করেছেন শহরে, ব্যয় করেছেন গ্রামে । মাটি থেকে জল একবার আকাশে গিয়ে আবার মাটিতেই ফিরে এসেছে- নইলে মাটি বন্ধ্যা মরু হয়ে যেত । আজকালকার দিনে গ্রামের থেকে যে প্ৰাণের ধারা শহরে চলে যাচ্ছে, গ্রামের সঙ্গে তার দেনা-পাওনার যোগ আর থাকছে না । আজ ধূমকেতু উড়িয়ে কলের শৃঙ্গ বাজল, মানুষকে দলে দলে তার স্নিগ্ধ সমাজস্থতি থেকে লোভ দেখিয়ে বের করে নিলে। মানুষ আবার ফিরল তার প্রথম আরম্ভের অবস্থায়- সেই আরণ্যক যুগের বর্বর ব্যক্তিস্বতন্ত্র্যই প্রবল দেহ নিয়ে আজ দেখা দিল ; আপনি আপনি স্বতন্ত্র ভোগের দুর্গ বেঁধে মানুষ অন্যকে শোষণ ও নিজেকে পোষণ করতে লাগল ; তখনকার কালের দস্যবৃত্তি দেহান্তর ধারণ করলে | গ্রামে একদিন অনেক মানুষ মিলেছিল, সকলে মিলে সংগ্ৰহ সঞ্চয় ও ভোগ করবার জন্যে। এখন সংখ্যায়। তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ একত্র মিলল, কিন্তু প্রত্যেকেই নিজের ভোগের কেন্দ্ৰ নিজে । তাই সমাজের সহজ বিধানের চেয়ে পুলিসের পাহারা কড়া হয়ে উঠল— আত্মীয়তার জায়গায় আইনের জটিলতা বাইরের শিকল পাকা করে তুলছে। নিজেরা প্রত্যেকেই যেখানে নিজের ভোগের কেন্দ্ৰ, সেখানে আমরা হয়। পরের দাসত্ব করি নয় নিজের, কিন্তু দুই-ই দাসত্ব। এই কর্মপাশবদ্ধ মানুষের সংখ্যা আজ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। প্রয়োজনের ক্ষেত্রে যারা মিলল, অন্তরের ক্ষেত্রে তাদের মিল নেই বলে এই সব পরিদাস ও আত্মদাসদের মনে ঈর্ষা বিদ্বেষ প্ৰবল ; প্রতিযোগিতার মন্থনদণ্ডে মিথ্যা ও হিংসাকে এরা নানা আকারে কেবলই মথিত করে তুলছে। ধনী-দরিদ্রে অন্তত আমাদের দেশে বিচ্ছেদ অতিমাত্র ছিল না- তার একটা কারণ, ধনের সম্মান অন্য-সব সম্মানের নীচে ছিল ;