পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\9ፃbr রবীন্দ্র-রচনাবলী কেটে গেছে, খাবার সময় কখন অতীত হয়ে যেত টের পেতেম না । আনন্দ ও উৎসাহের সঙ্গে এ কাজ করেছি। যে ব্যক্তি বালককাল থেকে ঘরের কোণে কাটিয়েছে, তার কাছে গ্রামের অভিজ্ঞতা। এই প্ৰথম । কিন্তু কাজের দুরূহতা আমাকে তৃপ্তি দিয়েছে, উৎসাহিত করেছে, নূতন পথনির্মাণের আনন্দ আমি লাভ করেছি। যতদিন পল্লীগ্রামে ছিলেম। ততদিন তাকে তন্ন তন্ন করে জানিবার চেষ্টা আমার মনে ছিল । কাজের উপলক্ষে এক গ্রাম থেকে আর-এক দূর গ্রামে যেতে হয়েছে, শিলাইদা থেকে পতিসর, নদীনালা-বিলের মধ্য দিয়ে- তখন গ্রামের বিচিত্র দৃশ্য দেখেছি। পল্লীবাসীদের দিনকৃত্য, তাদের জীবনযাত্রার বিচিত্র চিত্র দেখে প্ৰাণ ঔৎসুকে ভরে উঠত। আমি নগরে পালিত, এসে পডলুম পল্লীশ্ৰীর কোলে- মনের আনন্দে কৌতুহল মিটিয়ে দেখতে লাগলুম। ক্রমে এই পল্লীর দুঃখদৈন্য আমার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল, তার জন্যে কিছু করব এই আকাঙক্ষায় আমার মন ছটফট করে উঠেছিল। তখন আমি যে জমিদারি-ব্যবসায় করি, নিজের আয়-ব্যয় নিয়ে ব্যস্ত, কেবল বণিক-বৃত্তি করে দিন কটাই, এটা নিতান্তই লজ্জার বিষয় মনে হয়েছিল। তার পর থেকে চেষ্টা করতুম— কী করলে এদের মনের উদবােধন হয়, আপনাদের দায়িত্ব এরা আপনি নিতে পারে। আমরা যদি বাইরে থেকে সাহায্য করি তাতে এদের অনিষ্টই হবে । কী করলে এদের মধ্যে জীবন সঞ্চার হবে, এই প্রশ্নই তখন আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। এদের উপকার করা শক্ত, কারণ এরা নিজেকে বড়ো অশ্রদ্ধা করে । তারা বলত, “আমরা কুকুর, কষে চাবুক মারলে তবে আমরা ঠিক থাকি ' ' আমি সেখানে থাকতে একদিন পাশের গ্রামে আগুন লাগল। গ্রামের লোকেরা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল, কিছু করতে পারে না ; তখন পাশের গ্রামের মুসলমানেরা এসে তাদের আগুন নেবাল । কোথাও জল নেই, তাদের ঘরের চাল ভেঙে আগুন নিবারণ করতে হল { নিজের ভালো তারা বোঝে না, ঘরভাঙার জন্য আমার লোকেরা তাদের মারধর করেছিল । মেরে ধরে এদের উপকার করতে হয় । অগ্নিকাণ্ড শেষ হয়ে গেলে তারা আমার কাছে এসে বললে, “ভাগ্যিস বাবুরা আমাদের ঘর ভাঙলে, তাই বাঁচতে পেরেছি !' তখন তারা খুব খুশি, বাবুরা মারধর করাতে তাদের উপকার হয়েছে তা তারা মেনে নিল, যদিও আমি সেটাতে লজা পেয়েছি । আমার শহুরে বুদ্ধি । আমি ভাবলুম, এদের গ্রামের মাঝখানে ঘর বানিয়ে দেব ; এখানে দিনের কাজের পর তারা মিলবে ; খবরের কাগজ, রামায়ণ-মহাভারত পড়া হবে ; তাদের একটা ক্লাবের মতো হবে । সন্ধ্যাবেলায় তাদের নিরানন্দ জীবনের কথা ভাবতে আমার মন ব্যথিত হত ; সেই একঘেয়ে কীর্তনের একটি পদের কেউ পুনরাবৃত্তি করছে, এইমাত্র । ঘর বাধা হল, কিন্তু সেই ঘর ব্যবহার হল না । মাস্টার নিযুক্ত করলুম, কিন্তু নানা অজুহাতে ছাত্র स्ट्रल ना । তখন পাশের গ্রাম থেকে মুসলমানেরা আমার কাছে এসে বললে, ওরা যখন ইস্কুল নিচ্ছে না। তখন আমাদের একজন পণ্ডিত দিন, আমরা তাকে রাখব, তার বেতন দেব, তাকে খেতে দেব } এই মুসলমানদের গ্রামে যে পাঠশালা তখন স্থাপিত হয়েছিল তা সম্ভবত এখনো থেকে গিয়েছে । অন্য গ্রামে যা করতে চেয়েছিলুম তা কিছুই হয় নি। আমি দেখলুম যে, নিজের উপর নিজের আস্থা এরা হারিয়েছে । প্রাচীন কাল থেকে আমাদের দেশে পরের উপর নির্ভর করবার ব্যবস্থা চলে আসছে। একজন সম্পন্ন লোক গ্রামের পালক ও আশ্রয় ; চিকিৎসা, শিক্ষার ভার, তারই উপর ছিল। এক সময় এই ব্যবস্থার আমি প্রশংসা করেছি। যারা ধনী, ভারতবর্ষের সমাজ তাদের উপর এইভাবে পরোক্ষ ট্যাক্স বসিয়েছে। সে ট্যাক্স তারা মেনে নিয়েছে ; পুকুরের পঙ্কোদ্ধার, মন্দিরনির্মাণ, তারাই করেছে । ব্যক্তিবিশেষ নিজের সম্পত্তির সম্পূর্ণ ভোগ নিজের ইচ্ছামত করতে পারে নি। কিন্তু ইউরোপের ব্যক্তিস্বাতন্ত্ৰ্যনীতিতে এর কোনো বাধা নেই। গ্রামের এই সব কর্তব্যসম্পাদনেই ছিল তাদের সন্মান ;