পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VOD NR রবীন্দ্র-রচনাবলী একঘটি জল দিতে প্ৰাণে কষ্ট হয়, কিন্তু কয়জনে মিলে সামান্য একটা কুয়ো খুঁড়তে পারবে না। কেহ। বলছে, “কোন জায়গায় দেব, ওর বাড়ির দুই হাত দূরে, ওর বাড়ির কাছে পড়ে ; আর-একজন যে জিতল, আমার চেয়ে দুই হাত জিতল- এটা সহ্য হয় না।” নিজেদের পরস্পর চেষ্টা-দ্বারা পরস্পর কল্যাণের প্রবৃত্তি কারও মনে জেগে উঠে না, সকলের যাতে কল্যাণ হয় সে চেষ্টা আমাদের দেশে হল না, তাতে দুৰ্গতির একশেষ হয়েছে। আমি দেখেছি- একটা গ্রামে মস্ত রাস্তা করে দেওয়া হয়েছিল, ক্রমাগত গোরুর গাড়ি যাওয়ার এক জায়গায় একটা খাদ হয়, বর্ধার সময় হাঁটু পর্যন্ত কাদা হয়, যাওয়া-আসার বড়ো কষ্ট হত। তার দুপাশে দুখানি বড়ো গ্রাম, দু ঘন্টা কাজ করলে এটা ভরাট করা যেতে পারে। কিন্তু তারা বললে, তারা দুঘণ্টা কাজ করবে, আর যারা কুঠিয়া থেকে কি অন্য জায়গা থেকে আসবে তারা কিছু করবে না- তারা সুবিধা পাবে! নিজে শত অসুবিধা ভোগ করবে। তবু পরের সুবিধা সহ্য করতে পারবে না- দূরের লোক তাদের ঠকালো ক্রমাগত এই ভয় । অনে৷ পরিশ্রম না করে আমার পরিশ্রমের সুবিধা ভোগ করবে, আমার পরিশ্রমের ফলে সকলের কল্যাণ হবে- এটা তারা সহ্য করতে পারে না । না করতে পারার কারণ এই- কর্মের পুরস্কার মনে মনে কল্পনা । নিজের পুরস্কার কামনা করে কর্মের প্রতি যে ঝোক জন্মে সে কর্মহীনকর্ম। সৰ্বসাধারণের কল্যাণ হােক, না হয় আমার পরিশ্রম হল, এ কথা তারা বুঝতে পারে না । দুঃখ দিয়ে এ কথা বুঝিয়ে দিতে হবে । বলতে হবে, মরতে হয় তারা মরুক, মৃত্যুদূতের কানমলা খেয়ে যদি তাদের চৈতনা হয় তাও ভালো । গ্রামে গ্রামে ঔষধপথ্য দিয়ে গোপালবাবু সরে যাবেন এ কথা তিনি বলেন নি বাটযাকে সেবা বলে তিনি তাই করছেন, বেশি দিন তা করবেন না । যেই তারা বুঝবে এই প্ৰণালীতে উপকার হয়, অমনি ওঁরা সরে আসবেন তাদের উপর ভার দিয়ে । গায়ে না গেলে বুঝতে পারবেন না। ম্যালেরিয়া কী ভীষণ প্রভাব বিস্তার করেছে। অনেকের যকৃৎ-পিলেতে পেট ভর্তি হয়ে আছে, সুতরাং ম্যালেরিয়া দূর করতে হবে- বেশি করে বুঝাবার দরকার নাই। আমরা অনেকে জানি ম্যালেরিয়া কিরকম গোপনে ধীরে ধীরে মানুষকে জীবস্মৃত করে রাখে । এ দেশে অনেক জিনিস হয় না ; অনেক জিনিস আরম্ভ করি, শেষ হতে চায় না ; অনেক কাজেই দুর্বলতা দেখতে পাই- পরীক্ষা করতে দেখা যায় ম্যালেরিয়া শরীরের মধ্য থেকে তেজ কেড়ে নিয়েছে। } চেষ্টা করবার ইচ্ছাও হয় না । সকলেই জানেন বাংলাদেশের কাজকর্মে পশ্চিম থেকে লোক আসে। যেখানে বাংলার জেলে ছিল সেখানে হিন্দুস্থানি জেলে এসেছে। বাংলাদেশে ম্যালেরিয়ায় প্রাণ নিন্তেজ, কাজেই উৎসাহ নেই। প্রভুরা বলেন বটে, চালাকি করছে, ঘন ঘন তামাক খাচ্ছে, মজুরের কাজ করে না, আফিসে কেরানির কাজে মন দেয় না। জোয়ান জোয়ান সাহেব, তোমরা বুঝবে কী করে- ওরা চালাকি করে না ; ম্যালেরিয়ায় যারা জীৰ্ণ নিয়ত কাজ করবার, কাজে মন দেবার শক্তি তাদের নাই ; মশার কামড় খেয়ে ওদের এরকম অবস্থা হয়েছে। কিছুদিন এ দেশে থাকো, এটা ভালো করে বুঝতে পারবে । তাই বলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে না, মহাপুরুষের দিকে তাকিয়ে থেকে না । সাহস করে- আমাদের দুঃখ আমরা নিবারণ করতে পারব, শুধু সাহস চাই। কোনো-একটা জায়গায় কোনো-একটা কর্মে যদি একবার জয়পতাকা খুলে দিতে পারো- সাহস আসবে । ম্যালেরিয়ায় কত লোক মরছে রিপোর্ট দেখলে আপনারা বুঝতে পারবেন। আমি শুনেছি তার খুব পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু তার চেয়ে বড়ো জিনিস হচ্ছে বিশ্বাস। বাংলাদেশ থেকে মশা দূর করা সম্পূর্ণ না হােক, এতটা পরিমাণেও যদি হয় অনেক উন্নতি হবে। এতে যে কেবল মশা মরবে তা নয়, জড়তা মরবে। নিজের প্রতি নিজের যে বিশ্বাস সেই চিরন্তন ভিত্তি, চিরকেলে ভিত্তি ; কিন্তু মশা চিরকাল থাকবে ঔর উপর যদি মশা মারবার ভার দিই। শক্তি যদি দেশের মধ্যে জাগে, গ্রামের লোক যদি বলে- “আমরা কারও দিকে তাকবি না। যে-কোনো পূণ্যালোভী উপকার করবে তাকে অবজ্ঞা করব, ভিক্ষা করব। তবু তেমন লোকের উপকার চাইব না। কলিকাতা থেকে যারা আসবে তাদের বলব তোমরা আমাদের ভরি সূফী নাম করতে এসেছ, কাগজে বড়ো বড়ো রিপোর্ট লিখবে, তাই দেখে সকলে বাহবা দিবে। কোনোদিন ।