পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্জীপ্ৰকৃতি Vaa দোষ দেব না, দোষ দেব মানুষের রিপুকে । খেজুরগাছ, তালগাছ বিধাতার দান ; তাড়িখানা মানুষের সৃষ্টি। তালগাছকে মারলেই নেশার মূল মরে না। যন্ত্রের বিষদাঁত যদি কোথাও থাকে, তবে সে আছে আমাদের লোভের মধ্যে। রাশিয়া এই বিষদাতটাকে সজোরে ওপড়াতে লেগেছে, কিন্তু সেইসঙ্গে যন্ত্রকে সুদ্ধ টান মারে নি। উল্টো, যন্ত্রের সুযোগকে সর্বজনের পক্ষে সম্পূর্ণ সুগম করে দিয়ে লোভের কারণটাকেই সে ঘুচিয়ে দিতে চায় । কিন্তু এই অধ্যবসায়ে সবচেয়ে তার বাধা ঘটছে। কোনখানে । যন্ত্রের সম্বন্ধে যেখানে সে অপটু ছিল সেখানেই। একদিন জারের সাম্রাজ্য-কালে রাশিয়ার প্রজা ছিল আমাদের মতো অক্ষম । তারা মুখ্যত ছিল চাষী । সেই চাষের প্রণালী ও উপকরণ ছিল আমাদেরই মতো আদ্যকালের । তাই আজ রাশিয়া ধনোৎপাদনের যন্ত্রটাকে যখন সৰ্বজনীন করবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত, তখন যন্ত্র যন্ত্রী ও কমী আনাতে হচ্ছে যন্ত্রদক্ষ কারবারী দেশ থেকে । তাতে বিস্তর ব্যয় ও বাধা । রাশিয়ার অনভ্যস্ত হাত দুটাে এবং তার মন না চলে দ্রুতগতিতে, না চলে নিপুণভাবে | অশিক্ষায় ও অনভ্যাসে আজ বাংলাদেশের মন এবং অঙ্গ যন্ত্র-ব্যবহারে মূঢ় । এই ক্ষেত্রে বোম্বাই আমাদেরকে যে পরিমাণে ছাড়িয়ে গেছে সেই পরিমাণেই আমরা তার পরোপজীবী হয়ে পড়েছি। বঙ্গ-বিভাগের সময় এই কারণেই আমাদের ব্যর্থতা ঘটেছিল, আবার যে-কোনো উপলক্ষে পুনশ্চ ঘটতে পারে। আমাদের সমর্থ হতে হবে,সক্ষম হতে হবে- মনে রাখতে হবে যে, আত্মীয়মণ্ডলীর মধ্যে নিঃস্ব কুটুম্বের মতো কৃপাপাত্র আর কেউ নেই। সেই বঙ্গবিভাগের সময়ই বাংলাদেশে কাপড় ও সুতোর কারখানার প্রথম সূত্রপাত । সমস্ত দেশের মন বড়ো ব্যবসায় বা যন্ত্রের অভ্যাসে পাকা হয় নি ; তাই সেগুলি চলছে নানা বাধার ভিতর দিয়ে মন্থরগমনে । মন তৈরি করে তুলতেই হবে, নইলে দেশ অসামর্থের অবসাদে তলিয়ে যাবে। ভারতবর্ষের অন্য প্রদেশের মধ্যে বাংলাদেশ সর্বপ্রথমে যে ইংরেজি বিদ্যা গ্ৰহণ করেছে সে হল পুঁথির বিদ্যা। কিন্তু যে ব্যাবহারিক বিদ্যায় সংসারে মানুষ জয়ী হয়, য়ুরোপের সেই বিদ্যাই সব-শেষে বাংলাদেশে এসে পৌছল। আমরা য়ুরোপের বৃহস্পতি গুরুর কাছ থেকে প্রথম হাতে-খড়ি নিয়েছি, কিন্তু য়ুরোপের শুক্রাচার্য জানেন কী করে মার বাচানো যায়- সেই বিদ্যার জোরেই দৈত্যেরা স্বৰ্গ দখল করে নিয়েছিল । শুক্রাচার্যের কাছে পাঠ নিতে আমরা অবজ্ঞা করেছি- সে হল হাতিয়ার-বিদ্যার পাঠ । এইজন্যে পদে পদে হেরেছি, আমাদের কঙ্কাল বেরিয়ে পড়ল । বোম্বাই প্রদেশে এ কথা বললে ক্ষতি হয় না যে, 'চরখা ধরে । সেখানে লক্ষ লক্ষ কলের চরখা পশ্চাতে থেকে তার অভাব পূরণ করছে। বিদেশী কলের কাপড়ের বন্যার বাধ বাধতে পেরেছে ঐ কলের চরখায়। নইলে একটিমাত্র উপায় ছিল নাগাসন্ন্যাসী সাজা । বাংলাদেশে হাতের চরখাই যদি আমাদের একমাত্র সহায় হয় তা হলে তার জরিমানা দিতে হবে বোম্বাইয়ের কলের চরখার পায়ে । তাতে বাংলার দৈন্যও বাড়বে, অক্ষমতাও বাড়বে। বৃহস্পতি গুরুর কাছে যে বিদ্যা লাভ করেছিতাকে পূর্ণতা দিতে হবে শুক্রাচার্যের কাছে দীক্ষা নিয়ে। যন্ত্রকে নিন্দা করে যদি নির্বাসনে পাঠাতে হয়, তা হলে যে মুদ্রাযন্ত্রের সাহায্যে সেই নিন্দা রটাই তাকে সুদ্ধ বিসর্জন দিয়ে হাতে-লেখা পুঁথির চলন করতে হবে । এ কথা মানব যে, মুদ্রাব্যন্ত্রের অপক্ষপাত দক্ষিণ্যে অপাঠ্য এবং কুপাঠ্য বইয়ের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। তবুওর আশ্রয় যদি ছাড়তে হয় তবে আর-কোনো একটা প্রবলতর যন্ত্রেরই সঙ্গে চক্রান্ত করে সেটা সম্ভব হতে পারবে । যাই হােক, বাংলাদেশেও একদিন বিষম ব্যর্থতার তাড়নায় ‘বঙ্গলক্ষ্মী নাম নিয়ে কাপড়ের কল দেখা দিয়েছিল। সাংঘাতিক মাির খেয়েও আজও সে বেঁচে আছে। তার পরে দেখা দিল ‘মোহিনী মিল ; একে একে আরো কয়েকটি কারখানা মাথা তুলেছে। i এদের যেমন করে হােক রক্ষা করতে হবে- বাঙালির উপর এই দায় রয়েছে। চাষ করতে করতে যে কেবল ফসল ফলে তা নয়, চাষের জমিও তৈরি করে। কারখানাকে যদি বঁাচাই তবে কেবল যে উৎপন্ন দ্রব্য পাব তা নয়, দেশে কারখানার জমিও গড়ে উঠবে।