পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 OO রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী বাংলার মিল থেকে যে কাপড় উৎপন্ন হচ্ছে, যথাসম্ভব একান্তভাবে সেই কাপড়ই বাঙালি ব্যবহার করবে বলে যেন প” করে । একে প্রাদেশিকতা বলে না, এ আত্মরক্ষা । উপবাসক্লিষ্ট বাঙালিব অন্নপ্রবাহ যদি অন্য প্রদেশের অভিমুখে অনায়াসে বইতে থাকে এবং সেইজন্য বাঙালির দুর্বলতা যদি বাড়তে থাকে, তবে মোটের উপর তাতে সমস্ত ভারতেরই ক্ষতি। আমরা সুস্থ সমর্থ হয়ে দেহরক্ষা করতে যদি পারি। তবেই আমাদের শক্তির সম্পূর্ণ চালনা সম্ভব হতে পারে। সেই শক্তি নিরশনক্ষীণতায় অবমন্দিত হলে তাতে, শুধু ভারতকে কেন, পৃথিবীকেই বঞ্চিত করা হবে। বাঙালির ঔদাসীন্যকে ধাক্কা দিয়ে দূর করা চাই। আমাদের কোন কারখানায় কিরকম সামগ্ৰী উৎপন্ন হচ্ছে বা? বার সেটা আমাদের সামনে আনতে হবে । কলকাতার ও অন্যান্য প্ৰাদেশিক নগরীর মিউনিসিপ্যালিটির কর্তব্য হবে প্রদর্শনীর সাহায্যে বাংলার সমস্ত উৎপন্নদ্রব্যের সংবাদ নিয়ত প্রচার করা, এবং বাঙালি যুবকদের মনে সেই উৎসাহ জাগানো যাতে, বিশেষ করে তারা বাঙালির হাতের ও কলের জিনিস ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয় । অবশেষে উপসংহারে একটা কথা বলতে ইচ্ছা করি । বোম্বাইয়ের যে-সমস্ত কারখানা দক্ষিণ-আফ্রিকার কয়লায় কল চালিয়ে কাপড় বিক্রি করছে, তাদের কাপড় কেনায় যদি আমাদের দেশাত্মবোধে বাধা না লাগে, তবে আমাদের বাংলাদেশের তাতিদের কেন নির্মম হয়ে মারি । বাঙালি দক্ষিণ-আফ্রিকার কোনো উপকরণ ব্যবহার করে না, করে বিলিতি সুতো । তারা বিলাতের আমদানি কোনো কল চালিয়ে কাপড় বোনে না, নিজেদের হাতের শ্রম ও কৌশল তাদের প্রধান অবলম্বন, আর যে তাতে বোনে সেও দিশি তাত । এখন যদি তুলনায় হিসাব করে দেখা যায়, আমাদের তীতের কাপড়ের ও বোম্বাই মিলের কাপড়ের কতটা অংশ বিদেশী, তা হলে কী প্রমাণ হবে । তা ছাড়া কেবলই কি পণ্যের হিসাবটাই বড়ো হবে, শিল্পের দাম তার তুলনায় তুচ্ছ ? সেটাকে আমরা মূঢ়ের মতো বধ করতে বসেছি। অথচ যে যন্ত্রের বাড়ি তাকে মারলুম। সেটা কি আমাদেরই যন্ত্র । সেই যন্ত্রের চেয়ে বাংলাদেশের বহু যুগের শিক্ষাপ্রাপ্ত গরিবের হাত দুখানা কি অকিঞ্চিৎকর । আমি জোর করেই বলব, পূজোর বাজারে আমাকে যদি কিনতে হয় তবে আমি নিশ্চয়ই বােম্বাইয়ের বিলিতি যন্ত্রের কাপড় ছেড়ে ঢাকার দিশি তাতের কাপড় অসংকোচে এবং গৌরবের সঙ্গেই কিনব । সেই কাপড়ের সুতোয় বাংলাদেশের বহু যুগের প্ৰেম এবং আপনি কৃতিত্ব গাথা হয়ে আছে। অবশ্য, সস্তা দামের যদি গরজ থাকে তা হলে মিলের কাপড় কিনতে হবে, কিন্তু সেজন্য যেন বাংলাদেশের বাইরে না। যাই । যাবা শৌখিন কাপড় বোম্বাই মিল থেকে বেশি দাম দিয়ে কিনতে প্ৰস্তুত, তারা কেন যে তার চেয়ে অল্পদামে তেমনি শৌখিন শান্তিপুরি কাপড় না কেনেন তার যুক্তি খুঁজে পাই নে। একদিন ইংরেজ বণিক বাংলাদেশের ঠান্তকে মেরেছিল, তাতির হাতের নৈপুণ্যকে আড়ষ্ট করে দিয়েছিল । আজ আমাদের নিজের দেশের লোকে তার চেয়ে বড়ো বজ্ৰ হানলে । যে হাত তৈরি হতে কতকাল লেগেছে সেই হাতকে অপটু করতে বেশি দিন লাগে না। কিন্তু স্বদেশের এই বহুকালের অৰ্চিত কারুলক্ষ্মীকে চিরদিনের মতো বিসর্জন দিতে কি কারো ব্যথা লাগবে না। আমি পুনর্বাের বলছি, কাপড়ের বিদেশী যন্ত্রে বিদেশী কয়লায় বিদেশী মিশাল যতটা, বিলিতি সুতো সত্ত্বেও তাতের কাপড়ে তার চেয়ে স্বল্পতর । আরো গুরুতর কথা এই যে, আমাদের তাতের সঙ্গে বাংলা শিল্প আছে বাধা । এই শিল্পের দাম অর্থের দামের চেয়ে কম নয়। এ কথা বলা বাহুল্য বাংলা তাতে স্বদেশী মিলের বা চরখার সুতো ব্যবহার করেও তাকে বাজারে চলন-যোগ্য দামে বিক্রি করা যদি সম্ভবপর হয়, তবে তার চেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারে না । স্বদেশী চরখার উৎপাদনশক্তি যখন সেই অবস্থায় পেঁৗছবে তখন তঁাতিকে অনুনয়-বিনয় করতেই হবে না ; কিন্তু যদি না পৌঁছয়, তবে বাঙালি তঁতিকে ও বাংলার শিল্পকে বিলিতি লৌহযন্ত্র ও বিদেশী কয়লার বেদীতে বলিদান করব না । ख्ञानि »७७♛