পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিবিধ প্রসঙ্গ । মনের বাগান-বাড়ি ভালোবাসা অথের আত্মসমর্পণ নহে। ভালোবাসা অর্থে নিজের যাহা কিছু ভালো তাহাই সমর্পণ করা । হৃদয়ে প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করা নহে; হৃদয়ের যেখানে দেবত্রভূমি, যেখানে মন্দির, সেইখানে প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করা । যাহাকে তুমি ভালোবাস তাহাকে ফুল দাও, কাটা দিও না ; তোমার হৃদয়-সরোবরের পদ্ম দাও, পঙ্ক দিও না । হাসির হীরা দাও, অশ্রুর মুক্ত দাও ; হাসির বিদ্যুৎ দিও না, অশ্রুর বাদল দিও না। প্রেম হৃদয়ের সারাভাগ মাত্র । হৃদয় মন্দন করিয়া যে অমৃতটুকু উঠে তাহাই । ইহা দেবতাদিগের ভোগ্য। অসুর আসিয়া খায়, কিন্তু তাহাকে দেবতার ছন্মবেশে খাইতে হয়। যাহাকে তুমি দেবতা বলিয়া জান তাহাকেই তুমি অমৃত দাও, যাহাকে দেবতা বলিয়া বোধ হইতেছে তাহাকেই অমৃত দাও । কিন্তু এমন মহাদেব সংসারে আছেন, যিনি দেবতা বটেন, কিন্তু যাহার ভাগ্যে অমৃত জুটে নাই, সংসারের সমস্ত বিষ তীহাকে পান করিতে হইয়াছে— আবার এমন রাহুও আছে যে অমৃত খাইয়া থাকে | যাহাকে তুমি ভালোবাস তীহাকে তোমার হৃদয়ের সমস্তটা দেখাইও না। যেখানে তোমার হৃদয়ের পয়ঃপ্ৰণালী, যেখানে আবর্জনা, যেখানে জঞ্জাল, সেখানে তঁহাকে লইয়া যাইও না ; তাহা যদি পাের। তবে আর তোমার কিসের ভালোবাসা ! তঁহাকে তোমার হৃদয়ের এমন অঞ্চলের ডিস্ট্রিক্ট জজ করিবে যেখানে ম্যালেরিয়া নাই, ওলাউঠা নাই, বসন্ত নাই। তাহাকে যে বাড়ি দিবে তাহার দক্ষিণ দিকে খোলা, বাতাস আনাগোনা করে, বড়ো বড়ো ঘর, সূর্যের আলোক প্রবেশ করে। ইহা যে করে সেই যথার্থ ভালোবাসে । এমন স্বার্থপর প্রণয়ী বোধ করি নাই যে মনে করে তাহার প্রণয়ীকে তাহার হৃদয়ের সমস্ত বঁাশঝাড়ে ঘুরাইয়া সমস্ত পচাপুকুরে স্নান করাইয়া, না বেড়াইলে যথার্থ ভালোবাসা হয় না। অনেকের মত তাঁহাই বটে, কিন্তু সংকোচে পারিয়া উঠে না। এ বড়ো অপূর্ব মত । অনেকে বলিয়া উঠিবেন, “এ কিরকম কথা ; যাহাকে তুমি খুব ভালোবাস, র্যাহাকে নিতান্ত আত্মীয় মনে করা যায়, তাহার নিকটে মনের কোনো ভাগ গোপন করা কি উচিত?” উচিত নহে তো কি ? সর্বাপেক্ষা আত্নীয় “নিজের" নিকটে স্বভাবত অনেকটা গোপন করিতে হয়। না করিলে চলে না, না করিলে মঙ্গল নাই। প্রকৃতি যাহাদের চক্ষে পাতা দেন নাই, যাহারা আবশ্যকমত চােখ বুজিতে পারে না, মনে যাহা কিছু আসে, যে অবস্থাতেই আসে, তাহার কুন্তীরচক্ষে পড়িবেই, তাহাদের পক্ষে অত্যন্ত দুৰ্দশা। আমরা অনেক মনোভাব ভালো করিয়া চাহিয়া দেখি না, চোখ বুজিয়া যাই। এরূপ করিলে সে ভাবগুলিকে উপেক্ষা করা হয়, অনাদর করা হয়। ক্রমে তাহারা ত্ৰিয়মাণ হইয়া পড়ে। এই ভাবগুলি প্রবৃত্তিগুলি যদি ঢাকিয়া রাখা না যায়- পরস্পরের কাছে প্রকাশ করিয়া, বৈঠকখানার মধ্যে, কথাবার্তার মধ্যে তাহদের ডাকিয়া আনা হয়- তাহদের সহিত বিশেষ চেন্নাশুনা হইয়া যায়তাহাদের কদৰ্য মূর্তি এমন সহিয়া যায় যে আর খারাপ লাগে না- সে কি ভালো ? ইহাতে কি তাহাদের অত্যন্ত আস্কারা দেওয়া হয় না? একে তো যাহাকে ভালোবাসি তাহাকে ভালো জিনিষ দিতে ইচ্ছা করে, দ্বিতীয়ত তাহাকে মন্দ জিনিষ দিলে মন্দ জিনিষের দর অত্যন্ত বাড়াইয়া দেওয়া হয়। তাহা ছাড়া বিষ দেওয়া, রোগ দেওয়া, প্রহার দেয়াকে কি দাতবৃত্তি বলে ?