পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিবিধ প্ৰসঙ্গ ○br> বসেন কেন ?” উপাৰ্জন করিতে করিতে বুড়া হইয়া গেলাম, অনেক টাকা করিয়াছি, কিন্তু এখনো এত বড়োমানুষ হইতে পারিলাম না যে আমি যে বড়োমানুষ এ কথা একেবারে ভুলিয়া যাইতে পারিলাম । সর্বদাই মনে হয় আমি বড়োমানুষ। কাজেই আংটি পরিতে হয়, কেহ যদি আমাকে রাজাবাহাদুর না বলিয়া বাবু বলে, তবেই চােখ রাঙাইয়া উঠিতে হয়। যে ব্যক্তি অতি সহজে খাবার হজম করিয়া ফেলিতে পারে, যাহার জীর্ণ খাদ্য অতি নিঃশব্দে নিরূপদ্রবে শরীরের রক্ত নির্মাণ করে, সে ব্যক্তির চব্বিশ ঘণ্টা 'আহার করিয়াছি বলিয়া একটা চেতনা থাকে না । কিন্তু যে হজম করিতে পারে না, যাহার পেট ভার হইয়া থাকে, পেট কামড়াইতে থাকে, সে প্রতি মুহুর্তে জানিতে পারে যে, হী, আহার করিয়াছি বটে। অনেকের টাকা আছে বটে, কিন্তু নিঃশব্দে টাকা হজম করিতে পারে না, পরিপাকশক্তি নাই- ইহাদের কি আর বড়োমানুষ বলে ! ইহাদের বড়োমানুষি করিবার প্রতিভা নাই । ইহারা ঘরে ছবি টাঙায় পরকে দেখাইবার জন্য ; শিল্পসৌন্দর্য উপভোগ করিবার ক্ষমতা নাই, এই জন্য ঘরটাকে একেবারে ছবির দোকান করিয়া তুলে । ইহারা গণ্ডা গণ্ডা গাঁহিয়ে বাজিয়ে নিযুক্ত রাখে, পাড়াপ্রতিবেশীদের কানে তালা লাগাইয়া দেয়, অথচ যথার্থ গান বাজনা উপভোগ করিবার ক্ষমতা নাই ! এই সকল চিনির বলদদিগকে প্রকৃতি গরীব মনুষ্য করিয়া গড়িয়াছেন । কেবল কতকগুলা জমিদারী ও টাকার থলিতে বেচারাদিগকে বড়োমানুষ করিবে কি করিয়া ? কিন্তু-ওযালা বড়োমানুষির কথা হইতে আরেক কথা মনে পড়িয়াছে। যে ব্যক্তি স্বভাবত বড়োমানুষ সেই ব্যক্তি যে বিনয়ী হইয়া থাকে। এ কথা পুরানো হইয়া গিয়াছে। কালিদাস বলিয়াছেন, অনেক জল থাকিলে মেঘ নামিয়া আসে, অনেক ফল ফলিলে গাছ নুইয়া পড়ে। গল্প আছে, নিউটন বলিয়াছেন তিনি জ্ঞানসমুদ্রের ধারে নুড়ি কুড়াইয়াছেন । নিউটন নাকি বিশেষ বড়োমানুষ লোক, তিনি ছাড়া এ কথা যে-সে লোকের মুখে আসিত না, গলায় বাধিয়া যাইত । অতএব দেখা যাইতে যাহারা স্বভাবত গরীব, প্রায় তাহারা অহংকারী হইয়া থাকে। ইহাও সহ্য হয়, কিন্তু এমন গরীবও আছে যাহারা প্ৰাণ খুলিয়া পরের প্রশংসা করিতে পারে না । প্রকৃতি সে ক্ষমতা তাহাদের দেন নাই। এমন লোক সংসারে পদে পদে দেখা যায়। এরূপ স্বভাব কাহাদের হয় ? সকলে যদি তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিয়া দেখেন, তবে দেখিতে পাইবেন- যাহারা স্বাভাবিক অহংকারী অথচ নিজের এমন কিছু নাই যাহা লইয়া নাড়াচাড়া করিতে পারে, তাহারাই এইরূপ করিয়া থাকে। একটা ভালো কবিতাপুস্তক দেখিয়াই তাহাদের মনে হয় “আমিও এইরূপ লিখিতে পারি, অথচ তাহারা কোনো জন্মে কবিতা লিখে নাই । অহংকার করিবার কিছুই খুঁজিয়া পাইতেছে না, অথচ প্রশংসা করাও দায় হইয়া পড়িয়াছে। সে বলিতে চায়, এ কবিতাটি বেশ হইয়াছে, কিন্তু ইহার চেয়েও ভালো কবিতা একটি আছে, অর্থাৎ সে কবিতাটি এখনো লেখা হয় নাই, কিন্তু লেখা যাইতেও পারে। ভালো কবিতাটি বাহির করিতে পারে না নাকি, সেই জন্য তাহার গায়ের জ্বালা ধরে। সুতরাং প্রশংসার মধ্যে একটা হুলবিশিষ্ট কিন্তুর কীট না রাখিয়া থাকিতে পারে না । একটা যে বিকটাকার “কিন্তু রাহু তাহার সকল প্ৰশংসাই গ্রাস করিয়া থাকে, সে রাহুটি আর কেহ নহে, সে তাহার অঙ্গহীন “আমি, তাহার অপরিতৃপ্ত ক্ষুধিত অহংকার। সে দৈত্য, তাহার প্রশংসাসুধা খাইবার অধিকার নাই, এই জন্য সকল সুধাকর চাদকে মলিন না করিয়া থাকিতে পারে না। তাহার নিজের জ্ঞান আছে সে একটা মস্ত লোক, অথচ প্রমাণ দিয়া অপরকে তাহা বুঝাইতে পারিতেছে না, সুতরাং সে সকলের যশকেই অসম্পূর্ণ রাখিয়া দেয়। সে মনে করে, “আমার ভাবী। যশোর জন্য অথবা ন্যায্য যশের জন্য অনেকটা জায়গা করিয়া রাখা উচিত। আমি তো নিজে কোনো