পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ܓ brܟ যশোর কাজ করিতে পারি নাই, অন্যের কোনো কাজকেই যখন খাতিরেই আনি না, তখন লোকদের বুঝা উচিত যে, হাতে-কলমে যদি কাজে প্রবৃত্ত হই। তবে না জানি কি কারখানাই হয় ? সে মনে করে যে, সেই ভাবী সম্ভাবিত যশের জন্য একটা সিংহাসন প্ৰস্তুত করিয়া রাখা উচিত, অন্যান্য সকলের যশের রত্নগুলি ভাঙিয়া এই সিংহাসনটি প্রস্তুত করা আবশ্যক। কিন্তু’-নামক অস্ত্ৰ দিয়া সকলের যশ হইতে রত্নগুলি ভাঙিয়া ইহারা রাখিয়া দেয়। আহা, এ বেচারীরা কি অসুখী ! ইহাদের এ রোগ নিবারণ হয়, যদি সত্য সত্য ন্যায্য উপায়ে ইহারা যশ উপাৰ্জন করিতে পারে। ইহাদের এমন স্বভাব নাই যে পরের প্রশংসা করিতে পারে, এমন শিক্ষা নাই যে পরের প্রশংসা করিতে পারে, এমন সম্বল নাই যে পরের প্রশংসা করিতে পারে- যে দিকে চাহি সেই দিকেই দারিদ্র্য। অনেক বড়োমানুষ অহংকারী আছে যাহাঁদের পরের প্রশংসা করিবার মতো সম্বল আছে, কিন্তু এমন হতভাগ্য দরিদ্র অহংকারী আছে যে নিজের অহংকার করিতেও পারে না। আবার পরের প্রশংসা করিতেও পারে না। ইহাদের “কিন্তু-পীড়িত প্রশংসাতে কেহ যেন ব্যথিত না হন, কারণ ইহাতে তাহাদেরই দারিদ্র্য প্রকাশ করে । এই ‘কিন্তু গুলি তাঁহাদেরই ভিক্ষার ঝুলি। বেচারী যশ উপার্জন করিতে পারে নাই, এই নিমিত্ত তোমার উপার্জিত যশ হইতে কিছু অংশ, চায়, তাই “কিন্তু-র ভিক্ষার বুলি পাতিয়াছে। দয়ালু মাংসাশী বাঙ্গালীদের মাংস খাওয়ার পক্ষে অনেকগুলি যুক্তি আছে, তাহা আলোচিত হওয়া আবশ্যক। আমার বিশ্বজনীন প্ৰেম, সকলের প্রতি দয়া এত প্রবল যে, আমি মাংস খাওয়া কর্তব্য কাজ মনে করি । আমাদের দেশের প্রাচীন দার্শনিক বলিয়া গিয়াছেন, আমাদের এই অসম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব পূর্ণ-আত্মার মধ্যে লীন করিয়া দেওয়াই সাধনার চরম ফল ! পূর্ণতর জীবের মধ্যে অপূর্ণতর জীবের নির্বাণমুক্তি প্রার্থনীয় নহে তো কি? একটা পশুর পক্ষে ইহা অপেক্ষা সৌভাগ্য আর কি হইতে পারে যে, সে মানুষ হইয়া গেল ; মানুষের জীবনীশক্তিতে অভাব পড়িলে একটা পশু তাহা পূরণ করিতে পারিল ; মানুষের দেহের মধ্যে প্রবেশ করিয়া মিলাইয়া গিয়া মানুষের রক্ত, মাংস, অস্থি, মজ্জা, সুখ, স্বাস্থ্য, উদ্যম তেজ নির্মাণ করিতে পারিল, ইহা কি তাহার সাধারণ সৌভাগ্যের বিষয় ! প্রথমত সে নিজে স্বপ্নের অগোচর সম্পূর্ণতা লাভ করিল, দ্বিতীয়ত মানুষের মতো একটা উন্নত জীবকে সম্পূর্ণতর করিল। ছাগলদের মধ্যে এমন দার্শনিক কি আজ পর্যন্ত কেহ জন্মায় নাই, যে তাহার লম্বা দাড়ি নাডিয়া সমবেত শিষ্যশিশুবৰ্গকে এই নির্বাণমুক্তির সম্বন্ধে ভ্যাকরণ-শুদ্ধ উপদেশ দেয়া! আহা, যদি কেহ এমন ছাগহিতৈষী জন্মিয়া থাকে। তবে তাহার নিকট আমার ঠিকানাটা পঠাইয়া দিই এবং সেই সঙ্গে লিখিয়া দিই যে, জ্ঞানালোকিত ইয়ং-ছাগদের মধ্যে যাহার মুক্তিকামনা আছে তিনি উক্ত ঠিকানায় আগমন করিলে সদয়হাদয় উপস্থিত লেখক মহাশয় তাহাকে মুক্তিদানপূর্বক বাধিত করিতে প্রস্তুত আছেন। যাহা হউক, পশুদের উপকার করিবার জন্য, ব্যয়সাধ্য হইলেও, দয়ার্ডচিত্ত লোকদের মাংস পাওয়া কর্তব্য । আমাদের দেশে এমন অনেক পণ্ডিত আছেন যাহাদের মত এই যে, ভাৰতবৰ্ষীয়েরা ইংরাজত্ব অর্থাৎ পঞ্চােত্ব প্রাপ্ত হইয়া যদি ইংরাজদের মধ্যে একেবারে লীন হইয়া যাইতে পারে, তবে সুখের বিষয় হয়। বিখ্যাত ইংরাজ কবি বলিয়াছেন যে, আমরা বােকা জানােয়ারের মাংস খাই, যেমন ছাগল, ভেড়া, গরু । অধিক উদাহরণের আবশ্যক নাই--- মুসলমানেরা আমাদের খাইয়াছেন, ইংরাজেরা আমাদের খাইতেছেন । যদি প্রমাণ হইল যে, আমরা বোকা জানোয়ারের মাংস খাইয়া থাকি, তবে দেখা যাকবোকা জানোয়ারেরা কি খায় । তাহারা উদ্ভিজ্জ খায় । অতএব উদ্ভিজ যাহারা খায় তাহারা বোকা । এমন দ্রব্য খাইবার আবশ্যক ? নির্বোিধদের আমরা গাধা, গরু, মেড়া, হস্তিমুর্থ কহিয়া থাকি। কখনো বিড়াল, ভল্লুক, সিংহ, বা ব্যাঘ্ৰমুৰ্থ বলি না। উদ্ভিজ্জভোজীদের এমন নাম খারাপ হইয়া গিয়াছে যে,