পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○brど) রবীন্দ্র-রচনাবলী একলা একজন মাত্র লোক কিছুই নহে। সে ব্যক্তিই নহে! সে, সাধারণ মনুষ্য সমাজের সম্পত্তি। শ্যামের সঙ্গেও তাহার যে সম্পর্ক, রামের সঙ্গেও তাহার সেই সম্পর্ক । সে সরকারী । সে অমিশ্র জলজনন বাম্পের মতো। যতক্ষণ জলজনন বাষ্প অমিশ্র ভাবে থাকে, ততক্ষণ বায়ুর সঙ্গেও তাহার যে সম্পর্ক, জলের সঙ্গেও তাহার সেই সম্পর্ক। অবশেষে আর গুটি দুই তিন বাষ্প আসিয়া যখন তাহার সঙ্গে মেলে, তখন আমরা স্থির করিয়া বলিতে পারি সে জল কি বায়ু। তেমনি একক আমার সহিত যখন আর গুটি দুই তিন ব্যক্তি আসিয়া জমা হয়, তখন আমি ব্যক্তি-বিশেষ হইয়া দাড়াই। আমার বন্ধু বান্ধব আত্মীয়গণ আমার সীমা । সাধারণ মনুষ্যদের হইতে আমাকে পৃথক করিয়া রাখা, আমাকে ব্যক্তিবিশেষ করিয়া রাখাই তাহদের কাজ । অতএব দেখা যাইতেছে আমাদের চারি দিকে কতকগুলি বিশেষ পরের আবশ্যক, সাধারণ পর হইতে তাহারা আমাদিগকে পর করিয়া রাখে । কতকগুলি পরকে আপনার করিতে না পাবিলে আমি “আপনি” হইতে পারি না ; “পর” দিয়া “আপনি”কে গড়িয়া তুলিতে হয় । নহিলে আমি মানুষ হই, ব্যক্তি হই না | আত্মীয় বন্ধু বান্ধব- নামক কতকগুলি পর আছেন, তাহারা পর্যকে পর করেন, আপনাকে আপনি রাখেন । আমাদের কেহই যদি আত্মীয় না থাকিত, তাহা হইলে আমাদের পরই বা কে থাকিত ? তাহা হইলে সকলেরই সঙ্গে আমার সমান সম্পর্ক থাকিত। রেখাব-নামক একটি সুর যতক্ষণ স্বতন্ত্র থাকে ততক্ষণ সে বেহাগেরও যেমন সম্পত্তি ক্যানেড়ারও তেমনি সম্পত্তি ও আমন শত সহস্র রাগিণীর সঙ্গে তাহার সমান যোগ । কিন্তু যেই তার চতুস্পার্থে আর কতকগুলি সুর আসিয়া একত্র হয় তখনি সে বিশেষ রাগিণী হইয়া দাঁড়ায় ও অবশিষ্ট সমুদায় রাগিণীকে পর বলিয়া গণ্য করে । তেমনি আমরা যে সকলে রেখােব গান্ধার প্রভৃতি একেকটি সুর না হইয়া বেহাগ ভৈরবী প্রভৃতি একেকটি রাগিণী হইয়াছি, তাহা কেবল আমাদের আত্মীয় বন্ধু বান্ধবের প্রসাদে । আমরা যে একলা থাকিতে পাই, বিরলে থাকিতে পারি, তাহার কারণ আমাদের বন্ধু বান্ধব আত্মীয়গণ আমাদিগকে চারি দিকে ঘেরিয়া রাখিয়াছেন বলিয়া। নতুবা আমরা মুক্ত জগতে লক্ষ লোকের মধ্যে গিয়া পড়িতাম, শত সহস্রের কোলাহলের মধ্যে আমাদিগকে বাস করিতে হইত । অতএব কতকগুলি লোক ঘনিষ্ঠ ভাবে আমাদের কাছাকাছি না থাকিলে আমরা একলা থাকিতে পাই না, বিরলে থাকিতে পারি না। আকারহীন, ভাষাহীন, অন্তঃপুরহীন, কুহেলিকাময় কতকগুলা অপরিস্ফুট ভাবের দল আমাদের মনের মধ্যে যেমন ঘোষাৰ্ঘেষি করিয়া আনাগোনা করে, পরস্পরের কোলাহলে পরস্পরে মিশাইয়া থাকে, সমাজের মধ্যে আমরা তেমনি থাকি । অবশেষে সে ভাবগুলিকে যখন বিযুক্ত করিয়া লইয়া তাহাদিগকে আকার দিয়া, ভাষাবদ্ধ করিয়া, তাহাদের জন্য এক একটা স্বতন্ত্র অন্তঃপুর স্থাপন করিয়া দিই, তখন তাহারা যেমন বিরলে থাকে, একক হইয়া যায়, আমরাও সংসারী হইয়া তেমনি হই । বেশি দেখা ও কম দেখা সাধারণের কাছে প্রেমের অন্ধ বলিয়া একটা বদনাম আছে। কিন্তু অনুরাগ অন্ধ না বিরাগ অন্ধ ? প্রেমের চক্ষে দেখার অর্থই সর্বাপেক্ষা অধিক করিয়া দেখা । তবে কি বলিতে চাও, যে সর্বাপেক্ষা অধিক দেখে সে কিছুই দেখিতে পায় না ? যে প্রতি কটাক্ষ দেখে, প্রতি ইঙ্গিত দেখে, প্ৰতি কথা শোনে, প্রতি নীরবতা শোনে, সে মানুষ চিনিতে পারে না ? যে ভাবুক কবিতা ভালোবাসে সে কবিতা বুঝিতে পারে না ? যে কবি প্রকৃতিকে প্রেমের চক্ষে দেখে সে প্রকৃতিকে দেখিতে পায় না ? বিজ্ঞানবিৎ কি কেবল দূরবীক্ষণ ও অণুবীক্ষণের সাহায্যেই বিজ্ঞানের সত্য আবিষ্কার করেন, তাহার কাছে যে