পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१०० রবীন্দ্র-রচনাবলী এইটে না মনে থাকাই বিনয়, আমাকে যে বিনয় প্রকাশ করিতে হইবে এইটে মনে থাকার নাম বিনয় নহে । যে বলে “আমি দরিদ্র সে বিনয়ী নহে ; যে স্বভাবতই প্ৰকাশ করে না যে “আমি ধনী’ সেই বিনয়ী । যাহার বিনয়বাক্য বলিবার আবশ্যক পড়ে না। সেই বিনয়ী। তবে কি না, বিদেশী ভাষা শিখিতে হইলে ব্যাকরণ পড়িতে হয়, অভিধান মুখস্থ করিতে হয় ; বিনয় যাহাদের পক্ষে বিদেশী, তাহাদিগকে বিনয়ের অভিধান মুখস্থ করিতে হয়। কিন্তু এই প্রকার মুখস্থ বিনয় সংসারের একজামিন পাস করিতেই কাজে দেখে, পরীক্ষাশালার বাহিরে কোনো কাজে লাগে না । ধরা কথা সমস্ত জীবন যে তত্ত্বগুলিকে জানিয়া আসিতেছি, মাঝে মাঝে তাহাদের এক একবার আবিষ্কার করিয়া ফেলি। তাড়াতাড়ি পাশের লোককে ডাকিয়া বলি, ওহে, আমি এই তত্ত্বটি জানিয়াছি। সে বিরক্ত হইয়া বলে, আঃ, ও তো জানা কথা! কিন্তু ঠিক জানা কথা নয়। তুমি উহা জান বটে, তবুও জান না। একটা তুলনা দিলে স্পষ্ট হইবে। বাতাস সর্বত্রই বিদ্যমান। তথাপি এক জন যদি বলিয়া উঠে "ওহে, এইখানে বাতাস আছে। তবে তাহাকে হাসিয়া উড়াইয়া দিতে পারি না, তেমনি আমরা যে সকল সাধারণ তত্ত্বের মধ্যে বাস করিয়া থাকি সেই তত্ত্বগুলি অবস্থাবিশেষে এক এক জনের গায়ে লাগে, অমনি সে বলে— অমুক তত্ত্বটি পাইতেছি। এক জন বন্ধু বলিতেছিলেন যে, আজকাল সার্বজনীন-উদারতা (humanity) প্রভৃতি কতকগুলি প্রশস্ত কথা উঠিয়াছে, সহসা মনে হয়, কত কি মূল্যবান তত্ত্ব উপাৰ্জন করিতেছি, কিন্তু সে সকল তত্ত্ব বাতাসের মতো। বার্তাস অত্যন্ত উপকারী পদার্থ বটে, কিন্তু এত সাধারণ যে তাহার কোনো মূল্য নাই। তেমনি উপরি-উক্ত তত্ত্বগুলি বড়ো বড়ো তত্ত্ব বটে, কিন্তু এত সাধারণ যে তাহার কোনো মূল্য নাই ; অথচ আজকাল তাঁহাদের এমনি বিশেষরূপে উত্থাপিত করা হইতেছে যে, যেন তাহারা কতই অসাধারণ ! তাহার কথাটা ঠিক মানি না। মহাত্মাদিগের “বসুধৈব কুটুম্বকং” এ কথাটি সকলেই জানেন, অথচ সকলের গায়ে লাগে না । এ তত্ত্বটি মাঝে মাঝে এক এক জনের গায়ে প্রবাহিত হয় অমনি সে বসুধৈব কুটুম্বকং প্রচার করিয়া বেড়ায় । পুরানো-কথা ধরা-কথা পারতপক্ষে কেহ বলিতে চাহে না ; অতএব পুরানো কথা যখন কাহারও মুখে শুনা যায়, তখন বিবেচনা করা উচিত- সে তাহা জানিত বটে কিন্তু আজ নতুন পাইয়াছে, আমাদের ভাগ্যে এখনো তাহ ঘটে নাই। অনেক “উড়ো-কথা”র অপেক্ষা ধরা-কথাকে আমরা কম জানি । আমরা নিজের চোখ দেখিতে পাই না, দর্পণ পাইলেই দেখিতে পাই ; ধরা-কথা ধরিতে পারি না, বিশেষ অভিজ্ঞতা পাইলে ধরি। অতএব যাহারা জানা-কথা জানে, তাহারা সাধারণের চেয়ে অধিক ୪୩୩ | অন্ত্যেষ্টিসৎকার ইংরাজশাসন-বিদ্বেষী একদল লোক ক্ৰোধাভরে বলেন- দেখ দেখি ইংরাজের কি অন্যায় ! প্ৰাচীন ভারতবর্ষের বিদ্যাবুদ্ধি লইয়া তাহার সভ্যতা ; ভারতবর্ষের বিষয় পাইয়া সে ধনী ; অথচ সেই ভারতবর্যের প্রতি তাহার কি অন্যায় ব্যবহার! আমার বক্তব্য এই যে, তাহারা তো ঠিক উত্তরাধিকারীর মতো কাজ করিতেছে। ভারতবর্ষের মুখাগ্নি করিতেছে, ভারতবর্ষের শ্ৰাদ্ধ করিতেছে, আরও কি চাও ! ভূত ভারতবর্ষ যখন মাঝে মাঝে স্থানে স্থানে উপদ্রব করিতেছিল, তখন বড়ো বড়ো কামান-গোলার পিণ্ডদান করিয়া তাহাকে একেবারে শান্ত করিয়াছে। তাহা ছাড়া শাস্ত্ৰে বলে, নিজের সন্তানদের