পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিবিধ প্ৰসঙ্গ ԳOC) কেনই বা থাকিবে ? তিনি নিজের কাছে নিজে সর্বদাই সম্রামে নত হইয়া থাকেন। তাহার নিজের সহচর নিজেই। অত বড়ো সহচর দিশের মধ্যে কোথায় মিলিবে ! প্রতিভা যখন মুহূর্ত কালের জন্য অতিথি হইয়া এক জন কবিকে বীণা করিয়া তাহার তন্ত্রী হইতে সুর বাহির করিতে থাকে তখন তিনি নিজের সুর শুনিয়া নিজে মুগ্ধ হইয়া পড়েন। বাল্মীকি র্তাহার নিজের রচিত রামকে যেমন ভক্তি করিতেন এমন কোনো ভক্ত করেন না এবং যতক্ষণ তিনি রামের চরিত্র সৃজন করিতেছিলেন ততক্ষণ তিনি নিজেই রাম হইয়াছিলেন ও র্তাহার নিজের মহান ভাবে নিজেই মোহিত হইয়া গিয়াছিলেন। এইরূপে র্যাহারা নিজেকে নিজেই ভক্তি করিতে পারেন, নিজের সাহচর্যে নিজে সুখ ভোগ করিতে পারেন, তাহাদিগকে আর দশ জনের হস্তে আত্মসমৰ্পণ করিতে হয় না। এক কথায়- যাহারা একলা থাকেন তাহারা আর পরের সহিত মিশিবার অবসর পান না । ইহাকেই বলে অহংকারবিবর্জিত আত্মম্ভরিতা । আত্মময় আত্মবিস্মৃতি কিন্তু ইহা বলিয়া রাখি, ভাবুক লোকদিগের নিজের প্রতি মনোযোগ দিবার যেমন অল্প অবসর ও আবশ্যক আছে, এমন আর কাহারও নহে। যহাদের পরের সহিত মিশিতে হয় তাহাদের যেমন চব্বিশ ঘণ্টা নিজের চর্চা করিতে হয়, এমন আর কাহাকেও না । তাহদের দিনরাত্রি নিজেকে মাজিতে-ঘষিতে সাজাইতে-গোজাইতে হয় । পরের চোখের কাছে নিজেকে উপাদেয় করিয়া উপহার দিতে হয় । এইরূপে যাহারা পরের সহিত মেশে, নিজের সহিত তাহাদের অধিকতর মিশিতে হয় । ইহারাই যথার্থ আত্মম্ভরি। ভাবুকগণ কবিগণ সর্বদাই নিজেকে ভুলিয়া থাকেন। কারণ র্তাহাদের নিজেকে মনে করাইয়া দিবার জন্য পর কেহ উপস্থিত থাকে না । নিজের সহিত ব্যতীত আর কাহারও সহিত ইহারা ভালো করিয়া মেশেন না বলিয়া ইহারা নিজের কথা ভাবেন না । ইহারাই যথার্থ আত্মময় আত্ম-বিস্মৃত । آیه ছোটো ভাব বর্তমান সভ্যতার প্রাণপণ চেষ্টা এই যে, কিছুই ফেলা না যায়, সকলই কাজে লাগে । মনােবিজ্ঞান একটা ক্ষুদ্র বালকের, একটা বদ্ধ পাগলের, প্রত্যেক ক্ষুদ্রতম চিন্তা খেয়াল মনোভাব সঞ্চয় করিয়া রাখিয়া দেয়- কাজে লাগিবে। সমাজবিজ্ঞান, শিশু সমাজের, অসভ্য সমাজের, প্রত্যেক ক্ষুদ্র অনুষ্ঠান, অর্থহীন প্রথা, পুঁথিতে জমা করিয়া রাখিতেছে- কাজে লাগিবে। এখনকার কবিরাও এমন সকল ক্ষুদ্র যৎসামান্য বিষয়গুলিকে কবিতায় পরিণত করেন, যাহা প্রাচীন লোকেরা গদ্যেরও অনুপযুক্ত মনে করিতেন । এখনকার শিল্পেও, যাহা সাধারণ লোকে অনাবশ্যক পুরাণ গলিত বলিয়া ফেলিয়া দেয়, তাহাও একটা না একটা কাজে খাটিয়া যাইতেছে । আমরা যখন বেড়াইতেছি, শুইয়া আছি, আহার করিতেছি, সংসারের ছোটােখাটাে খুঁটিনাটি কাজ সমাধা করিতেছি, তখন আমাদের মনের মধ্যে কত শত খুচরা বাজে ভােব আনাগোনা করিতে থাকে,