পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ver রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী এদের মধ্যে কোনো কোনো মেয়ের আত্মবিদ্রোহ দেখা দিল । তারা বলতে লাগল, মেয়ে-পুরুষের এইরকম ফেষঘোষি তফাত করে দেওয়া এখনকার কালের উলটাে চাল। বিরুদ্ধবাদিনীরা বলত, পুরুষেরা যে বিশেষ করে আমাদের সমাদর করবে, আমাদের চৌকি এগিয়ে দেবে, আমাদের রুমাল কুড়িয়ে দেবে, এই তাে যা হওয়া উচিত। সূরীতি তাকে অপমান বলবে কেন । আমরা তাে বলি এই আমাদের সম্মান । পুরুষদের কাছ থেকে আমাদের সেবা আদায় করা চাই। একদিন ছিল যখন মেয়েরা ছিল সেবিকা, দাসী। এখন পুরুষেরা এসে মেয়েদের স্তবস্তুতি করে— এই সমাদর, সুবীতি যাই বলুক, আমরা ছাড়তে পারব না। এখন পুরুষ আমাদের দাস ।" এইরকম গোলমাল ভিতরে ভিতরে জেগে উঠল। সকলের মধ্যে। বিশেষ করে সলিলার এই নীৱস ক্লাসের রীতি ভালো লাগত না । সে ধনী ঘরের মেয়ে, বিরক্ত হয়ে চলে গেল দাৰ্জিলিঙে ইংরেজি কলেজে। এমনি করে দুটাে-একটি মেয়ে খসে যেতেও শুরু করেছিল, কিন্তু সুব্রীতির মন কিছুতেই लव्न न् । মেয়েদের মধ্যে, বিশেষত সুরীতির, এই গুমর ছেলেদের অসহ্য হয়ে উঠল। তারা নানারকম করে ওর উপর উৎপাত শুরু করলে । গণিতের মাস্টার ছিলেন খুব কড়া । তিনি কোনোরকম ছ্যাবলামি সহ্য করতেন না । তারই ক্লাসে একদিন মহা গোলমাল বেধে গেল । সূরীতির ডেস্কে তার বাপের হাতের অক্ষরে লেখা লেফাফা- খুলবামাত্রই তার মধ্য থেকে একটা আরসোলা ফরফর করে বেরিয়ে এল। মহা চেঁচামেচি বেধে গেল। সে জন্তুটা ভয় পেয়ে পাশের মেয়ের খোপার উপরে আশ্রয় নিলে । সে এক বিষম হাউমাউ কাণ্ড । গণিতের মাস্টার বেণীবাবু খুব কড়া কটাক্ষপাত করবার চেষ্টা করতে লাগলেন, কিন্তু আরসোলার ফর ফরানির উপরে তীর শাসন খাটবে কী করে । সেই চেঁচামেচিতে ক্লাসের মানরক্ষা আর হয় না ; আর-একদিন- সুব্রীতির নোট বইয়ের পাতায় পাতায় ছেলেরা নাসি৷ দিয়েছে ভরে, খুব কড়া নাস্যি। বইটা খুলতেই ঘোরতর হাঁচির ছোয়াচে উৎপাত বেধে গেল। সে গুড়ো পাশের মেয়েদের নাকে ঢুকে পড়ল । সকলকে নাকের জলে চোখের জলে করে দিলে। আর ঘন ঘন হ্যাচ্চো শব্দে পড়াশুনা বন্ধ হয় আর-কি । মাস্টার আড়াচোখে দেখেন- দেখে তারও হাসি চাপা শক্ত হয়ে ওঠে । একদিন রব উঠল। কোনো মহারাজা কলেজ দেখতে আসবেন, বিশেষ করে মেয়েদের ক্লাস । কানে কানে গুজব রটল— তঁার এই দেখতে আসার লক্ষ্য ছিল বধু জোগাড় করা । একদল মেয়ে ভােন করলে যে, তাদের যেন অপমান করা হচ্ছে। কিন্তু ওরই ভিতরে দেখা গেল সেদিনকার খোপায় কিছু শিল্পকাজ, সেদিনকার পাড়ে কিছু রঙ । লোকটি তো যে-সে নয়, সে ক্রোড়পতি । মেয়েদের মনের মধ্যে একটা হুড়োমুড়ি ছিল সকলের আগে তার চােখে পড়বার । তার পরে ক্লাস তো হয়ে গেল । একটা দূত এসে জানালে যে তীর পছন্দ ঐ সুরীতিকেই। সুব্রীতি জানে, এ রাজার তহবিলে অগাধ টাকার জোরে পুরুষ জাতির সমস্ত নীচতা কোথায় তলিয়ে যায় । ভান করলে এ প্রস্তাবে সে যে কেবল রাজি নয় তা নয়, বরঞ্চ সে অপমানিত বোধ করছে । কেননা, মেয়েদের ক্লাস তো গোহাটা নয়, যে, ব্যবসায়ী এসে গোরু বাছাই করে নিয়ে যাবে। কিন্তু মনে-মনে ছিল আর-একটু সাধ্যসাধনার প্রত্যাশা ৷ ঠিক এমন সময় খবর পাওয়া গেল, মহারাজা তার সমস্ত পাগড়ি-টাগড়ি-সমেত অন্তর্ধান করেছেন । তিনি বলে গিয়েছেন, বাঙালি মেয়েদের মধ্যে একটাকেও বাছাই করে নেবার যোগ্য তিনি দেখলেন না । এর চেয়ে তাদের পশ্চিমের বেদের মেয়েরাও অনেক ভালো । ক্লাস-সুদ্ধ মেয়েরা একেবারে জ্বলে উঠল। বললে, কে বলেছিল তঁকে আমাদের এই অপমান করতে আসতে ! সেদিন তাদের সাজসজ্জার মধ্যে যে একটু কারিগরি দেখা গিয়েছিল সেটা লজ্জা দিতে লাগল। এমন সময়ে প্রকাশ পেল— মহারাজটি তাদেরই একজন পুরোনাে ছাত্র । বাপ-মায়ের বিষয়-সম্পত্তি জুয়ো খেলে উড়িয়ে দিয়ে সে খুঁজে বেড়াচ্ছে টাকাওয়ালা মেয়ে। মেয়েদের মাথা ঠোঁট হয়ে গেল। সূরীতি বার বার করে বলতে লািগল- সে একটুও বিশ্বাস করে নি। সে প্রথম থেকেই কেবল যে বিশ্বাস করে নি তা নয়, সে কলেজের প্রন্সিপালকে এই পড়ার ব্যাঘাত নিয়ে নালিশ করতে