পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ Vd পর্যন্ত তৈরি ছিল । হয়তো ছিল, কিন্তু তার তো কোনো দলিল পাওয়া গেল না । এমনি করে একটার পর আর-একটা উৎপাত চলতেই লাগল। এই সমস্ত উপদ্রবের প্রধান পাণ্ডা ছিল নীহার । একবার ডিগ্রি নিতে যাচ্ছিল যখন সুরীতি, তার পাশে এসে নীহার বললে, “কী গো গরবিনী, টিতে যে পা পড়ছে না ।” সুৱীতি মুখ বেঁকিয়ে বললে, “দেখুন, আপনি আমার নাম নিয়ে ঠাট্টা করবেন না।” নীহার বললে, “তুমি বিদুষী হয়ে একে ঠাট্টা বলো, এ যে বিশুদ্ধ ক্লাসিক্যাল সাহিত্য থেকে কোটেশন করা !! এমন সম্মান কি আর কোনো নামে হতে পারে !” “আমাকে আপনার সম্মান করতে হবে না।” । “সন্মান না করে বাচি কী করে ! হে বিকচকমলায়তলোচনা, হে পরিণতশরচ্চন্দ্ৰবদনা, হে স্মিতহাস্যাজ্যোৎস্নাবিকাশিনী, তোমাকে আদরের নামে ডেকে যে তৃপ্তির শেষ হয় না।” “দেখুন, আপনি আমাকে রাস্তার মধ্যে যদি এরকম অপমান করেন, আমি প্রিন্সিপালের কাছে নালিশ করব ।” “নালিশ করতে হয় কোরো, তবে অপমানের একটা সংজ্ঞা ঠিক করে দিয়ে । এর মধ্যে কোন শব্দটা অপমানের ? বল তো আমি আরো চড়িয়ে দিতে পারি। বলব- হে নিখিলবিশ্বহৃদয়-উন্মদিনী”- রাগে। লাল হয়ে সুরীতি দ্রুতপদে চলে গেল। তার পিছন দিকে খুব একটা হাসির ধ্বনি উঠল। ডাক পড়তে লাগল, “ফিরে চাও হে রোষারুণলোচনা, হে যৌবনমদমত্তমাতঙ্গিনী”- তার পরের দিন ক্লাস আরম্ভ হবার মুখেই রব উঠল, “হে সরস্বতী-চরণকমলদলবিহারিণী-গুঞ্জনমত্ত-মধুব্ৰতা, পূৰ্ণচন্দ্ৰনিভাননী”- সূরীতি রেগে গিয়ে পাশের ঘরে সুপারিনটেন্ডেন্ট গোবিন্দবাবুকে বললে, “দেখুন, আমাকে কথায় কথায় অপমান করলে আমি থাকব না ।” তিনি এসে বললেন ক্লাসের ছেলেদের, “তোমরা কেন ওকে এত উপদ্রব করছি।” নীহার বললে, “একে কি উপদ্রব বলে ! যদি কেউ নালিশ করতে পারে, তবে পূৰ্ণচন্দ্ৰই করতে পারতেন যে তাকে আমি ঠাট্টা করেছি। আমাদের ক্লাসে যোগেশ বলে- ওগুলো বাদ দিয়ে শুধু ওকে । নিভাননা বললেই হয়, কেননা কলমের নিভের মতন সুতীক্ষা ওর মুখ | শুনে বরং আমি বলেছিলুম ‘ছি, এরকম করে বলতে নেই, ওঁরা হলেন বিদুষী- কথাটা চাপা দিয়েছিলুম। কিন্তু পূৰ্ণচন্দ্রনিভাননাতে আমি তো দোষের কিছু দেখি নি।” । ছেলেরা বললে, “আপনি বিচার করে দেখুন, আমরা মনের আনন্দে আউড়ে গিয়েছিলুম- হে সরস্বতীচরণকমলদলবিহারিণী গুঞ্জনমত্তমধুব্রতা ! প্রথমত কথাটা নিন্দার নয়, দ্বিতীয়ত সেটা যে ওরই ধ্ৰুংকুকুর বলা এত বড় অহংকার ও কেন্ন হল। ঘরেতে আরো তাে ছাত্র আছে, তার তাে ळ्न ן" সুপারিনটেন্ডেন্ট বললেন, “অস্থানে অসময়ে এরকম সম্ভাষণগুলো লোকে পরিহাস বলেই নেয়। দরকার কী বলা ?” "দেখুন। সার, মন যখন উতলা হয়ে ওঠে তখন কি সময় অসময়ের বিচার থাকে। তা ছাড়া আমাদের এ সম্ভাষণ যদি পরিহাসই হয়, তা হলে তো এটা কেউ গায়ে না নিয়ে হেসে উড়িয়ে দিতে পারতেন । আর আপনার কলেজে এত বড়ো বড়ো সব বিদুষী, ঐরা কি পরিহাসের উত্তরে পরিহাস করতেও জানেন না ? এদের দম্ভরুচিকৌমুদীতে কি হাস্যমধুরী জাগবে না। তা হলে আমরা সব *াষত সুধাপিপাসু পুরুষগুলো বাচি কী করে ।” Y. এইরকম কথা-কাটাকাটির পালা চলত যখন তখন। সূরীতি অস্থির হয়ে উঠল- তার স্বাভাবিক গীভীর্ষ আর টােক না। সে ঠাট্টা করতে জানে না, অথচ কড়া জবাব করবার ভাষাও তার আসে না।