পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর 8 ow) ব্ৰহ্মা মানুষকে নিয়ে যে কাও করেছিলেন এর সঙ্গে তার সম্পূর্ণই তফাত। মানুষের খোলের মধ্যে ঘূর্ণিচাকার মোটর-কল না বসিয়ে মন বলে অত্যন্ত ছট্‌ফটে একটা পদার্থ ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই বালাইটাকে বিদায় করতে না পারলে মানুষকে কল করে তোলা দুঃসাধ্য। ঐহিক বা পারত্রিক ভয়ে বা লোভে বা মোহমন্ত্রে এই মনটাকে আধমরা করে তবে কর্তারা এক দলের কাছে কেবলই আদায় করছেন তাতের কাপড়, আর-এক দলের কাছে কেবলই ঘানির তেল ; এক দল কেবলই জোগাচ্ছে তাদের ফরমাশের হাড়ি, আর-এক দল বানাচ্ছে লাঙলের ফাল । তার পরে যদি দরকার হয় মহুষোচিত কোনো বড়ো কাজে তাদের মন পেতে তারা ব’লে বসে, ‘মন ? সেটা আবার কোন আপদ। হুকুম করে-না কেন । মন্ত্র আওড়াও । গাছ বসিয়ে বেড়া তৈরি করতে গেলে সব গাছকেই সমান খাটো করে ছাটতে হয়। তেমনি করে আমাদের এই ছাট মনের মুল্লুকে মানুষের চিত্তধর্মকে যুগে যুগে দাবিয়ে রেখেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজকেকার অবাধ্যতার যুগে এ দিকে ও দিকে তার গোটাকতক ডালপালা বিদ্রোহী হয়ে সাম্যসৌষম্যকে অতিক্রম করে যদি বেরিয়ে পড়বার দুষ্টলক্ষণ দেখায়, যদি সকলেরই মন আজ আঁধার রাতের ঝিল্লিধ্বনির মতো মৃত্যু গুঞ্জনে একটিমাত্র উপদেশমন্ত্রের সমতান-অনুকরণ না করে, তা হলে কেউ যেন উদবিগ্ন বা বিরক্ত না হন ; কেননা স্বরাজের জন্তে আশা করা তখনই হবে খাটি । এইজন্তেই কবুল করতে লজ্জা হচ্ছে না (যদিও লোকভয় যথেষ্ট আছে ) যে, এ পর্যন্ত চরকার আন্দোলনে আমার মন ভিতর থেকে দোল খায় নি । অনেকে সেটাকে আমার স্পর্ধ বলে মনে করবেন, বিশেষ রাগ করবেন। কেননা বেড়জালে যখন অনেক মাছ পড়ে, তখন যে মাছটা ফসকে যায় তাকে গাল না পাড়লে মন খোলসা হয় না। তথাপি আশা করি, আমার সঙ্গে প্রকৃতিতে মেলে এমন লোকও অনেক আছেন। র্তাদের সকলকে বাছাই করে নেওয়া শক্ত ; কেননা চরকা সম্বন্ধে তাদের সকলের হাত চলে না, অথচ মুখ খুব মুখর বেগেই চলে। যে-কোনো সমাজেই কর্মকাণ্ডকে জ্ঞানকাণ্ডের উপরে বসিয়েছে, সেইখানেই মামুষের সকল বিষয়ে পরাভব । বুদ্ধ থেকে আরম্ভ করে ভারতের মধ্যযুগের সাধু সাধক র্যাদেরই দেখি, যারাই এসেছেন পৃথিবীতে কোনো মহাবার্তা বহন করে, তারা সকলেই আমনস্ক যান্ত্রিক বাহিক আচারের বিরোধী। তারা সব বাধা ভেদ করে কথা কয়েছিলেন মানুষের অন্তরাত্মার কাছে। তারা কৃপণের মতে, হিসাবি বিজ্ঞলোকের মতো এমন কথা বলেন নি যে, আগে বাহিক, তার পরে আন্তরিক ; আগে অন্নবস্ত্র, তার পরে আত্মশক্তির পূর্ণতা।