পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালাস্তর ৪২৩ ভদ্রলোকে মিলে ভারতের রাজগদি ভাগাভাগি করে নেওয়াই পলিটিক্স। সেই পলিটিক্সে যুদ্ধবিগ্রহ সদ্ধিশান্তি উভয় ব্যাপারই বস্তৃতামঞ্চে ও খবরের কাগজে, তার অস্ত্র বিশুদ্ধ ইংরাজি ভাষা— কখনও অনুনয়ের করুণ কাকলি, কথনও বা কৃত্রিম কোপের উত্তপ্ত উদ্দীপনা। আর দেশে যখন এই প্ৰগলভ বাগ বাত্য বায়ুমণ্ডলের উর্ধ্বস্তরে বিচিত্র বাপলীলা-রচনায় নিযুক্ত তখন দেশের যারা মাটির মানুষ তারা সনাতন নিয়মে জন্মাচ্ছে মরছে, চাষ করছে, কাপড় বুনছে, নিজের রক্তে মাংসে সর্বপ্রকার শ্বাপদ-মানুষের আহার জোগাচ্ছে, যে দেবতা তাদের ছোয়া লাগলে অশুচি হন মন্দিরপ্রাঙ্গণের বাইরে সেই দেবতাকে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করছে, মাতৃভাষায় কাদছে হাসছে, আর মাথার উপর অপমানের মুষলধারা নিয়ে কপালে করাঘাত করে বলছে 'অদৃষ্ট । দেশের সেই পোলিটিশান আর দেশের সর্বসাধারণ, উভয়ের মধ্যে অসীম দূরত্ব। সেই পলিটিক্স আজ মুখ ফিরিয়েছে, অভিমানিনী যেমন করে বল্লভের কাছ থেকে মুখ ফেরায়। বলছে, কালো মেঘ আর হেরব না গো দূতী। তখন ছিল পূর্বরাগ ও অভিসার, এখন চলছে মান এবং বিচ্ছেদ। পালা বদল হয়েছে, কিন্তু লীলা বদল হয় নি। কাল যেমন জোরে বলেছিলেম ‘চাই’, আজ তেমনি জোরেই বলছি 'চাই নে’। সেই সঙ্গে এই কথা যোগ করেছি বটে যে, পল্লীবাসী জনসাধারণের অবস্থার উন্নতি করাতে চাই। অর্থাৎ, এরাই আমার আপন, ওরা আমার পর । কিন্তু 'চাই নে 'চাই নে বলবার হুহুংকারেই গলার জোর গায়ের জোর চুকিয়ে দিই। তার সঙ্গে যেটুকু ‘চাই জুড়ি তার আওয়াজ বড়ো মিহি। যে অছিলাতেই অর্থ কিছু সংগ্ৰহ করি ভদ্রসমাজের পোলিটিকাল বারোয়ারি জমিয়ে তুলতেই তা ফুরিয়ে যায়, তার পরে অর্থ গেলে শব্দ যেটুকু বাকি থাকে সেটুকু থাকে পল্লীর হিতের জন্তে। অর্থাৎ, আমাদের আধুনিক পলিটিকসের শুরু থেকেই আমরা নিৰ্বগুণ দেশপ্রেমের চর্চা করেছি দেশের মানুষকে বাদ দিয়ে। এই নিরুপাধিক প্রেমচর্চার অর্থ র্যারা জোগান তাদের কারো বা আছে জমিদারি, কারো বা আছে কারখানা ; আর শব্দ যারা জোগান তারা আইনব্যবসায়ী। এর মধ্যে পল্লীবাসী কোনো জায়গাতেই নেই ; অর্থাৎ আমরা যাকে দেশ বলি সেই প্রতাপাদিত্যের প্রেতলোকে তারা থাকে না । তারা অত্যন্ত প্রতাপহীন— কি শবসেম্বলে কি অর্থসম্বলে। যদি দেওয়ানি অবাধ্যতা চলত তা হলে তাদের ডাকতে হত বটে, সে কেবল খাজনা বন্ধ করে মরবার জন্তে । আর, যাদের অন্ত-ভক্ষ্য-ধনুৰ্বগুণ তাদের এখনও মাঝে মাঝে ডাক পাড়া হয় দোকান বন্ধ করে হরতাল করবার জন্তে, উপরওয়ালাদের কাছে আমাদের পোলিটিকাল বাক ভঙ্গীটাকে অত্যন্ত তেড়া করে দেখাবার উদ্দেশ্যে ।