পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর 8&S হলে সমাজের মতে কেবল যে বারুণীর স্বানের পুণ্য সে হারাত তা নয়, সে দণ্ডনীয় হত, তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত। তার ঘরে এসে রোগী যদি মরত তা হলে সমাজে সে বিষম বিপন্ন হয়ে পড়ত। যে মানবধর্ম সকল নিরর্থক আচারের বহু উর্ধের্ব তাকে দণ্ড , মেনে নিতে হবে আচারীদের হাতে । একজন প্রাচীন অধ্যাপক আমাকে বললেন, তার গ্রামের পথে ধূলিশায়ী আমাশয়রোগে-পীড়িত একজন বিদেশী পথিককে তিনি হাটের টিনের চালার নীচে স্থান দিতে অনুরোধ করেছিলেন । যার সেই চালা সে বললে, পারব না। তিনিও লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করলেন যে, তিনিও সমাজের দণ্ডের ভয়েই তাকে আশ্রয় দিতে পারেন নি । অর্থাৎ মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্যসাধন শাস্তির যোগ্য । তিনি হোমিওপ্যাথি জানতেন, পথের ধারেই তাকে কিছু ওষুধপত্র দিয়েছিলেন। আরোগ্যের দিকে যাচ্ছিল, এমনসময় রাত্রে শিলাবৃষ্টি হল ; পরদিন সকালে দেখা গেল, সে মরে পড়ে আছে। পাপপুণ্যের বিচার এতবড়ে বীভৎসতায় এসে ঠেকেছে। মানুষকে ভালোবাসায় অশুচিত, তাকে মনুষোচিত সম্মান করায় অপরাধ। আর জলে ডুব দিলেই সব অপরাধের ক্ষালন । এর থেকে মনে হয়, যে অভাব মানুষের সকলের চেয়ে বড়ো অভাব সে প্রেমের অভাব। সে প্রেমের অভাবকে হৃদয়ে নিয়ে আমরা যাকে শুচিত বলে থাকি তাকে রক্ষা করতে পারি, কিন্তু মনুষ্যত্বকে বাচাতে পারি নে। আশা করি, দুৰ্গতির রাত্রি-অবসানে দুৰ্গতির শেষ সীমা আজ পেরোবার সময় এল। আজ নবীন যুগ এসেছে। আর্যে-অনার্ষে একদা যেমন মিলন ঘটেছিল, শ্রীরামচন্দ্র যেমন চণ্ডালকে বুকে বেঁধেছিলেন, সেই যুগ আজ সমাগত। আজও যদি আমাদের মধ্যে প্রেম না আসে, কঠিন কঠোর নিষ্ঠুর অবজ্ঞা মানুষের থেকে মানুষকে দূর করে রাখে, তবে বাচব কী করে। রাউণ্ড, টেবিলে গিয়ে, ভোটের সংখ্যা নিয়ে কাড়াকড়ি করে ? পশুর প্রতি আমরা যে ব্যবহার করি মানুষকে যদি তার চেয়েও অধম স্থান দিই তবে সেই অধমত কি আমাদের সমস্ত সমাজেরই বুকের উপর চেপে বসবে না। মানুষকে কৃত্রিম পুণ্যের দোহাই দিয়ে দূরে রেখেছি, তারই অভিশাপে আজ সমস্ত জাতি অভিশপ্ত। দেশজোড়া এতবড়ো মোহকে যদি আমরা ধর্মের সিংহাসনে স্থিরপ্রতিষ্ঠ করে বসিয়ে রাখি তবে শক্রকে বাইরে খোজবার বিড়ম্বনা কেন । নবযুগ আসে বড়ো দুঃখের মধ্য দিয়ে। এত আঘাত এত অপমান বিধাতা আমাদের দিতেন না যদি এর প্রয়োজন না থাকত। অসহ বেদনায় আমাদের প্রায়শ্চিত চলছে, এখনও তার শেষ হয় নি। কোনো বাহ পদ্ধতিতে পরের কাছে ভিক্ষা করে আমরা স্বাধীনতা পাব না ; কোনো সত্যকেই এমন করে পাওয়া যায় না। মানবের