পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

WÐX e রবীন্দ্র-রচনাবলী বিহারী দূরের দিকে চাহিয়া নীরবে বসিয়া রহিল। অন্নপূর্ণ অঞ্চল হইতে এক জোড়া মোট সোনার বালা খুলিয়া কহিলেন, “বাবা, এই বালাজোড়া তুমি রাখো— বউমা যখন আসিবেন, আমার আশীর্বাদ দিয়া তাহাকে পরাইয়া দিয়ে৷ ” বিহারী বালাজোড়া মাথায় ঠেকাইয়া অশ্র সংবরণ করিতে পাশের ঘরে চলিয়া গেল । বিদায়কালে অন্নপূর্ণ কহিলেন, “বেহারি, আমার মহিনকে আর আমার আশাকে দেখিস ।” রাজলক্ষ্মীর হস্তে একখানি কাগজ দিয়া বলিলেন, “শ্বশুরের সম্পত্তিতে আমার যে অংশ আছে, তাহা এই দানপত্রে মহেন্দ্রকে লিখিয়া দিলাম । আমাকে কেবল মাসে মাসে পনেরোটি করিয়া টাকা পাঠাইয়া দিয়ো ।” বলিয়া ভূতলে পড়িয়া রাজলক্ষ্মীর পদধূলি মাথায় তুলিয়া লইলেন এবং বিদায় হইয়া তীর্থোদেশে যাত্র করিলেন । فسوا আশা কেমন ভয় পাইয়া গেল। এ কী হইল। মা চলিয়া যান, মাসিমা চলিয়া যান। তাহাদের স্থখ যেন সকলকেই তাড়াইতেছে, এবার যেন তাহাকেই তাড়াইবার পালা। পরিত্যক্ত শূন্য গৃহস্থালির মাঝখানে দাম্পত্যের নূতন প্রেমলীলা তাহার কাছে কেমন অসংগত ঠেকিতে লাগিল । সংসারের কঠিন কর্তব্য হইতে প্রেমকে ফুলের মতো ছিড়িয়া স্বতন্ত্র করিয়া লইলে, তাহা কেবল আপনার রসে আপনাকে সজীব রাখিতে পারে না, তাহা ক্রমেই বিমর্ষ ও বিকৃত হইয়া আসে। আশাও মনে মনে দেখিতে লাগিল, তাহীদের অবিশ্রাম মিলনের মধ্যে একটা প্রাস্তি ও দুর্বলতা আছে । সে মিলন যেন থাকিয়া থাকিয়া কেবলই মুষড়িয়া পড়ে— সংসারের দৃঢ় ও প্রশস্ত আশ্রয়ের অভাবে তাহাকে টানিয়া খাড়া রাখাই কঠিন হয়। কাজের মধ্যেই প্রেমের মূল না থাকিলে, ভোগের বিকাশ পরিপূর্ণ এবং স্থায়ী হয় না। মহেন্দ্রও আপনার বিমুখ সংসারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়া আপন প্রেমোৎসবের সকল বাতিগুলাই একসঙ্গে জালাইয়া খুব সমারোহের সহিত শূন্তগুহের অকল্যাণের মধ্যে মিলনের আনন্দ সমাধা করিতে চেষ্টা করিল। আশার মনে সে একটুখানি খোচা দিয়াই কহিল, "চুনি, তোমার আজকাল কী হইয়াছে বলে দেখি। মাসি গেছেন, তা লইয়া অমন মন ভার করিয়া আছ কেন । আমাদের দু-জনার ভালোবাসাতেই কি সকল ভালোবাসার অবসান নয় ?”