পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি \ტჯჯ) কখনো অনুরোধ করিয়ো না!” সেই বড়ো অভিমানের কথা অন্নপূর্ণার কানে বাজিতেছিল। র্তাহার একান্ত অতুগত সেই স্নেহের বিহারীকে তিনি এমন মনভাঙা অবস্থায় ফেলিয়া আসিয়াছিলেন, তাহাকে কোনো সাৰনা দিতে পারেন নাই। অন্নপূর্ণ অত্যন্ত বিমর্ষ ও ভীত হইয়া ভাবিতে লাগিলেন, “এখনো কি আশার প্রতি বিহারীর মন পড়িয়া আছে ।” মহেন্দ্র কখনো ঠাট্টার ছলে, কখনো গম্ভীরভাবে, তাহাদের ঘরকন্নার আধুনিক সমস্ত খবর-বার্তা জানাইল, কেবল বিনোদিনীর কথার উল্লেখমাত্র করিল না । এখন কালেজ খোলা, কাশীতে মহেন্দ্রের বেশি দিন থাকিবার কথা নয় । কিন্তু কঠিন রোগের পর স্বাস্থ্যকর আবহাওয়ার মধ্যে গিয়া আরোগ্যলাভের যে স্থখ, মহেন্দ্র কাশীতে অন্নপূর্ণার নিকটে থাকিয়া প্রতিদিন সেই মুখ অনুভব করিতেছিল— তাই একে একে দিন কাটিয়া যাইতে লাগিল । নিজের সঙ্গে নিজের যে একটা বিরোধ জন্মিবার উপক্রম হইয়াছিল, সেটা দেখিতে দেখিতে দূর হইয়া গেল। কয়দিন সর্বদ ধর্মপরায়ণা অন্নপূর্ণার স্নেহমুখচ্ছবির সম্মুখে থাকিয়া, সংসারের কর্তব্যপালন এমনি সহজ ও সুখকর মনে হইতে লাগিল যে, তাহার পূর্বেকার আতঙ্ক হাস্যকর বোধ হইল । মনে হইল, বিনোদিনী কিছুই না । এমন কি, তাহার মুখের চেহারাই মহেন্দ্র স্পষ্ট করিয়া মনে আনিতে পারে না । অবশেষে মহেন্দ্র খুব জোর করিয়াই মনে মনে কহিল, “আশাকে আমার হৃদয় হইতে এক চুল সরাইয়া বসিতে পারে, এমন তো আমি কোথাও কাহাকেও দেখিতে পাই না ।” মহেন্দ্র অন্নপূর্ণকে কহিল, ”কাকীমা, আমার কালেজ কামাই যাইতেছে— এবারকার মতো তবে আসি। যদিও তুমি সংসারের মায়া কাটাইয়া একাস্তে আসিয়া আছ—তবু অনুমতি করো মাঝে মাঝে আসিয়া তোমার পায়ের ধুলা লইয়া যাইব ।” মহেন্দ্র গৃহে ফিরিয়া আসিয়া যখন আশাকে তাহার মাসির স্নেহোপহার সি দুরের কৌটা ও একটি সাদা পাথরের চুমকি ঘটি দিল, তখন তাহার চোখ দিয়া ঝরঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল । মাসিমার সেই পরমশ্নেহময় ধৈর্য ও মাসিমার প্রতি তাহাদের ও তাহার শাশুড়ীর নানাপ্রকার উপদ্রব স্মরণ করিয়া তাহার হৃদয় ব্যাকুল হইয়া উঠিল। স্বামীকে জানাইল, “আমার বড়ো ইচ্ছা করে, আমি একবার মাসিমার কাছে গিয়া তাহার ক্ষমা ও পায়ের ধুলা লইয়া আসি। সে কি কোনোমতেই ঘটিতে পারে না ।” মহেন্দ্র আশার বেদনা বুঝিল, এবং কিছুদিনের জন্য কাশীতে সে তাহার মাসিমার