পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী وVوا®ا রুদ্ধকণ্ঠ বিহার তেমনি পাংশুমুখে তাহার চৌকি হইতে উঠিয়া মহেঞ্জের দিকে ধাবিত হইল— হঠাৎ থামিয়া বহুকষ্টে স্বর বাহির করিয়া কহিল, “ঈশ্বর তোমাকে ক্ষমা করুন, আমি বিদায় হই ।” বলিয়া টলিতে টলিতে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল । পাশের ঘর হইতে বিনোদিনী ছুটিয়া আসিয়া ডাকিল, “বিহারী-ঠাকুরপো ।” বিহারী দেয়ালে ভর করিয়া একটুখানি হাসিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, “কী, বিনোদ- বোঠান ।” বিনোদিনী কহিল, “ঠাকুরপো, চোখের বালির সঙ্গে আমিও কাশীতে যাইব ।” বিহারী কহিল, “না না, বোঠান, সে হইবে না, সে কিছুতেই হইবে না । তোমাকে মিনতি করিতেছি— আমার কথায় কিছুই করিয়ো না । আমি এখানকার কেহ নই, আমি এখানকার কিছুতেই হস্তক্ষেপ করিতে চাহি না, তাহাতে ভালো হইবে না । তুমি দেবী, তুমি যাহা ভালো বোধ কর, তাহাই করিয়ো । আমি চলিলাম।” বলিয়া বিহারী বিনোদিনীকে বিনম্র নমস্কার করিয়া চলিল । বিনোদিনী কহিল, “আমি দেবী নই ঠাকুরপো, শুনিয়া যাও । তুমি চলিয়া গেলে কাহারও ভালো হইবে না। ইহার পরে আমাকে দোষ দিয়ে না।” বিহারী চলিয়া গেল। মহেন্দ্র স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া ছিল । বিনোদিনী তাহার প্রতি জলস্ত বঞ্জের মতো একটা কঠোর কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া পাশের ঘরে চলিয়া গেল । সে-ঘরে আশা একান্ত লজ্জায় সংকোচে মরিয়া যাইতেছিল। বিহারী তাহাকে ভালোবাসে, এ-কথা মহেঞ্জের মুখে শুনিয়া সে আর মুখ তুলিতে পারিতেছিল না । কিন্তু তাহার উপর বিনোদিনীর আর দয়া হইল না । আশা যদি তখন চোখ তুলিয়া চাহিত, তাহা হইলে সে ভয় পাইত । সমস্ত সংসারের উপর বিনোদিনীর যেন খুন চাপিয়া গেছে। মিথ্যা কথা বটে। বিনোদিনীকে কেহই ভালোবাসে না বটে ! সকলেই ভালোবাসে এই লজ্জাবতী ননির পুতুলটিকে । মহেন্দ্র সেই ষে আবেগের মুখে বিহারীকে বলিয়াছিল, “আমি পাষণ্ড”— তাহার পর আবেগ-শাস্তির পর হইতে সেই হঠাৎ আত্মপ্রকাশের জন্য সে বিহারীর কাছে কুষ্ঠিত হইয়া ছিল । সে মনে করিতেছিল, তাহার সব কথাই যেন ব্যক্ত হইয়া গেছে । সে বিনোদিনীকে ভালোবাসে না, অথচ বিহারী জানিয়াছে যে সে ভালোবাসে,— ইহাতে বিহারীর উপরে তাহার বড়ো একটা বিরক্তি জন্মিতেছিল। বিশেষত, তাহার পর হইতে যতবার বিহারী তাহার সম্মুখে আসিতেছিল তাহার মনে হইতেছিল, যেন বিহারী সকৌতুহলে তাহার একটা ভিতরকার কথা খুজিয়া