পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V©ፃ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী যাইবই, আমাকে যেমন করিয়া হোক পাঠাইয়া দাও— তা নয়, কখনো স্থা, কখনো না, কখনো চুপচাপ— এ কী রকম।” হঠাৎ মহেঞ্জের এই উগ্রতা দেখিয়া আশা বিস্মিত ভীত হইয়া উঠিল । সে অনেক চেষ্টা করিয়া কোনো উত্তরই ভাবিয়া পাইল না । মহেন্দ্র কেন যে কখনো হঠাৎ এত আদর করে, কখনো হঠাৎ এমন নিষ্ঠুর হইয়া উঠে, তাহা সে কিছুই বুঝিতে পারে না । এষ্টরূপে মহেন্দ্র যতই তাহার কাছে অধিক দুর্বোধ্য হইয়া উঠিতেছে, ততই আশার কম্পান্বিত চিত্ত ভয়ে ও ভালোবাসায় তাহাকে যেন অত্যন্ত অধিক করিয়া বেষ্টন করিয়া ধরিতেছে । মহেন্দ্রকে আশা মনে মনে সন্দেহ করিয়া চোখে চোখে পাহারা দিতে চায় ! ইহা কি কঠিন উপহাস, না নির্দয় সন্দেহ ? শপথ করিয়া কি ইহার প্রতিবাদ আবগুক, না হাস্ত করিয়া ইহা উড়াইয়া দিবার কথা ? হতবুদ্ধি আশাকে পুনশ্চ চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া অধীর মহেন্দ্র দ্রুতবেগে সেখান হইতে উঠিয়া চলিয়া গেল । তখন কোথায় রহিল মাসিক পত্রের সেই গল্পের নায়ক, কোথায় রহিল গল্পের নায়িকা । সুর্যাস্তের আভা অন্ধকারে মিশাইয়া গেল, সন্ধ্যারম্ভের ক্ষণিক বসন্তের বাতাস গিয়া শীতের হাওয়া দিতে লাগিল— তখনো আশা সেই মাছুরের উপর লুষ্ঠিত হইয়া পড়িয়া রহিল । অনেক রাত্রে আশা শয়নঘরে গিয়া দেখিল, মহেন্দ্র তাহাকে না ডাকিয়াই শুইয়া পড়িয়াছে । তখনই আশার মনে হইল, স্নেহময়ী মাসীর প্রতি তাহার উদাসীনতা কল্পনা করিয়া মহেন্দ্র তাহাকে মনে মনে ঘৃণা করিতেছে। বিছানার মধ্যে ঢুকিয়াই আশা মহেঞ্জের দুই পা জড়াইয়া তাহার পায়ের উপর মুখ রাখিয়া পড়িয়া রহিল । তখন মহেন্দ্র করুণায় বিচলিত হইয়া তাহাকে টানিয়া লইবার চেষ্টা করিল । অাশ৷ কিছুতেই উঠিল না । সে কহিল, “আমি যদি কোনো দোষ করিয়া থাকি, আমাকে মাপ করে ।” মহেন্দ্র আর্দ্রচিত্তে কহিল, “তোমার কোনো দোষ নাই, চুনি । আমি নিতান্ত পাষণ্ড, তাই তোমাকে অকারণে আঘাত করিয়াছি।” তখন মহেঞ্জের দুই পা অভিষিক্ত করিয়া আশার অশ্র ঝরিয়া পড়িতে লাগিল । মহেন্দ্র উঠিয়া বসিয়া তাহাকে দুই বাহুতে তুলিয়া আপনার পাশে শোয়াইল । আশার রোদনৰেগ থামিলে সে কহিল, “মাসিকে কি আমার দেখিতে ঘাইবার ইচ্ছা করে না। কিন্তু তোমাকে ফেলিয়া আমার বাইতে মন সরে না । তাই আমি যাইতে চাই নাই, তুমি রাগ করিয়ো না।”