পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○為● রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রেম এতদিন নেপথ্যের আড়ালে লুকাইয়া বসিয়া ছিল— আজ সে সম্মুখে আসিয়া পর্দা উঠাইয়া দিয়াছে । জগৎসংসারের উপর হইতে আবরণ উঠিয়া গেছে। প্রতিদিনের পৃথিবীর সমস্ত তুচ্ছতা আজ অন্তৰ্হিত হইল। গাছপালা, পশুপক্ষী, পথের জনতা, নগরের কোলাহল, সকলই আজ অপরূপ । এই বিশ্বব্যাপী নূতনতা এতকাল ছিল কোথায় । ஆ মহেন্দ্রের মনে হইতে লাগিল, আজ যেন বিনোদিনীর সঙ্গে অন্তদিনের মতো সামান্তভাবে মিলন হইবে না। আজ যেন কবিতায় কথা বলিলে এবং সংগীতে ভাব প্রকাশ করিলে, তবে ঠিক উপযুক্ত হয় । আজিকার দিনকে ঐশ্বর্ষে সৌন্দর্যে পূর্ণ করিয়া মহেন্দ্র স্বষ্টিছাড়া সমাজছাড়া একটা আরব্য উপন্যাসের অদ্ভুত দিনের মতো করিয়া তুলিতে চায়। তাহা সত্য হইবে, অথচ স্বপ্ন হইবে – তাহাতে সংসারের কোনো বিধিবিধান, কোনো দায়িত্ব, কোনো বাস্তবিকতা থাকিবে না । আজ সকাল হইতে মহেন্দ্র চঞ্চল হইয়া বেড়াইতে লাগিল, কলেজে যাইতে পারিল না ; কারণ, মিলনের লগ্নটি কখন অকস্মাৎ আবিভূত হইবে, তাহা তো কোনো পঞ্জিকায় লেখে না । গৃহকার্যে রত বিনোদিনীর কণ্ঠস্বর মাঝে মাঝে ভাড়ার হইতে, রান্নাঘর হইতে মহেন্দ্রের কানে আসিয়া পৌছিতে লাগিল। আজ তাহা মহেন্দ্রের ভালো লাগিল না— আজ সে বিনোদিনীকে মনে মনে সংসার হইতে বহুদূরে স্থাপন করিয়াছে। সময় কাটিতে চায় না। মহেন্দ্রের স্নানাহার হইয়া গেল— সমস্ত গৃহকর্মের বিরামে মধ্যাহ্ন নিস্তব্ধ হইয়া আসিল । তবু বিনোদিনীর দেখা নাই । দুঃখে এবং মুখে, অধৈর্ষে এবং আশায় মহেন্দ্রের মনোযন্ত্রের সমস্ত তারগুলা ঝংকৃত হইতে লাগিল । কালিকার কাড়াকড়ি-করা সেই বিষবৃক্ষখানি নিচের বিছানায় পড়িয়া আছে । দেখিবামাত্র সেই কাড়াকাড়ির স্মৃতিতে মহেন্দ্রের মনে পুলকাবেশ জাগিয়া উঠিল । বিনোদিনী যে-বালিশ চাপিয়া শুইয়াছিল, সেই বালিশট টানিয়া লইয়া মহেন্দ্র তাহতে মাথা রাখিল ; এবং বিষবৃক্ষখানি তুলিয়া লইয়া তাহার পাতা উলটাইতে লাগিল । ক্রমে কখন এক সময় পড়ায় মন লাগিয়া গেল, কখন পাচটা বাজিয়া গেল— ছশ হইল না । * է এমন সময় একটি মোরাদাবাদি খুঞ্চের উপর থালায় ফল ও সন্দেশ এবং রেকবে বরফচিনিসংযুক্ত স্বগন্ধি দলিত থরমুজ লইয়া বিনোদিনী ঘরে প্রবেশ করিল এবং মহেন্দ্রের সম্মুখে রাখিয়া কহিল, "কী করিতেছ, ঠাকুরপো । তোমার হইল কী । পাচটা বাজিয়া গেছে, এখনো হাতমুখ-ধোয়া কাপড়-ছাড়া হইল नां ?”