পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি . O3S মহেঞ্জের মনে একটা ধাক্কা লাগিল । মহেন্দ্রের কী হইয়াছে, সে কি জিজ্ঞাসা করিবার বিষয়। বিনোদিনীর সে কি অগোচর থাকা উচিত। আজিকার দিন কি অন্য দিনেরই মতো। পাছে যাহা আশা করিয়াছিল, হঠাৎ তাহার উলটা কিছু দেখিতে পায়, এই ভয়ে মহেন্দ্র গতকল্যকার কথা স্মরণ করাইয়া কোনো দাবি উত্থাপন করিতে পারিল না । মহেন্দ্র থাইতে বসিল । বিনোদিনী ছাদে-বিছানো রৌদ্রে-দেওয়া মহেঞ্জের কাপড়গুলি দ্রুতপদে ঘরে বহিয়া আনিয়া নিপুণ হস্তে ভাজ করিয়া কাপড়ের আলমারির মধ্যে তুলিতে লাগিল । মহেন্দ্ৰ কহিল, "একটু রোসো, আমি খাইয়া উঠিয়া তোমার সাহায্য করিতেছি।” বিনোদিনী জোড়হাত করিয়া কহিল, “দোহাই তোমার, আর যা কর সাহায্য করিয়ো না ।” মহেন্দ্ৰ খাইয়া উঠিয়া কহিল, “বটে ! আমাকে অকৰ্মণ্য ঠাওরাইয়াছ । আচ্ছা, আজ আমার পরীক্ষা হউক।” বলিয়া কাপড় ভাজ করিবার বৃথা চেষ্টা করিতে লাগিল । বিনোদিনী মহেন্দ্রের হাত হইতে কাপড় কাড়িয়া লইয়া কহিল, “ওগো মশায়, তুমি রাখো, আমার কাজ বাড়াইয়ো না ।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “তবে তুমি কাজ করিয়া যাও, আমি দেখিয়া শিক্ষালাভ করি।” বলিয়া আলমারির সম্মুখে বিনোদিনীর কাছে আসিয়া মাটিতে আসন করিয়া বসিল । বিনোদিনী কাপড় ঝাড়িবার ছলে একবার করিয়া মহেন্দ্রের পিঠের উপর আছড়াইয়া কাপড়গুলি পরিপাটিপূর্বক ভাজ করিয়া আলমারিতে তুলিতে লাগিল। - আজিকার মিলন এমনি করিয়া আরম্ভ হইল। মহেন্দ্র প্রত্যুষ হইতে ষেরূপ কল্পনা করিতেছিল, সেই অপূর্বতার কোনো লক্ষণই নাই। এরূপ ভাবে মিলন কাব্যে লিখিবার, সংগীতে গাহিবার, উপন্যাসে রচিবার যোগ্য নহে। কিন্তু তবু মহেন্দ্র দুঃখিত হইল না, বরঞ্চ একটু আরাম পাইল । তাহার কাল্পনিক আদর্শকে কেমন করিয়া খাড়া করিয়া রাখিত, কিরূপ তাহার আয়োজন, কী কথা বলিত, কী ভাব প্রকাশ করিতে হইত, সকলপ্রকার সামান্যতাকে কী উপায়ে দূরে রাথিত, তাহা মহেন্দ্র ঠাওরাইতে পারিতেছিল না— এই কাপড় ঝাড়া ও ভঁাজ করার মধ্যে হাসিতামাশা করিয়া সে যেন স্বরচিত একটা অসম্ভব দুরূহ আদর্শের হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া বাচিল । এমন সময় রাজলক্ষ্মী ঘরে প্রবেশ করিলেন । মহেন্দ্রকে কহিলেন, “মহিন, বউ কাপড় তুলিতেছে, তুই ওখানে বসিয়া কী করিতেছিল।”