পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 • রবীন্দ্র-রচনাবলী বিহারী। পুথি সাধে খুলিয়া রাখি, বোঠান। হৃদয়কে হৃদয়েরই নিয়মে বুঝিবার ভার অন্তৰ্বামীরই উপরে থাক, আমরা পুথির বিধান মিলাইয়া না চলিলে শেষকালে যে ঠেকাইতে পারি না । বিনোদিনী । শুন ঠাকুরপো, আমি নির্লজ্জ হইয়া বলিতেছি, তুমি আমাকে ফিরাইতে পারিতে। মহেন্দ্র আমাকে ভালোবাসে বটে, কিন্তু সে নিরেট অন্ধ, আমাকে কিছুই বোঝে না। একবার মনে হইয়াছিল, তুমি আমাকে যেন বুঝিয়াছ— একবার তুমি আমাকে শ্রদ্ধা করিয়াছিলে– সত্য করিয়া বলে, সে-কথা আজ চাপা দিতে চেষ্টা করিয়ো না । বিহারী। সত্যই বলিতেছি, আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করিয়াছিলাম । বিনোদিনী । ভুল কর নাই ঠাকুরপো, কিন্তু বুঝিলেই যদি, শ্রদ্ধা করিলেই যদি, তবে সেইখানেই থামিলে কেন । আমাকে ভালোবাসিতে তোমার কী বাধা ছিল। আমি আজ নির্লজ্জ হইয়া তোমার কাছে আসিয়াছি, এবং আমি আজ নির্লজ্জ হইয়াই তোমাকে বলিতেছি—তুমিও আমাকে ভালোবাসিলে না কেন। আমার পোড়াকপাল । তুমিও কি না আশার ভালোবাসায় মজিলে। না, তুমি রাগ করিতে পাইবে না। বসে ঠাকুরপো, আমি কোনো কথা ঢাকিয়া বলিব না। তুমি যে আশাকে ভালোবাস, সে-কথা তুমি যখন নিজে জানিতে না, তখনো আমি জানিতাম। কিন্তু আশার মধ্যে তোমরা কী দেখিতে পাইয়াছ, আমি কিছুই বুঝিতে পারি না । ভালোই বল আর মন্দই বল, তাহার আছে কী । বিধাতা কি পুরুষের দৃষ্টির সঙ্গে অস্তদৃষ্টি কিছুই দেন নাই। তোমরা কী দেখিয়া, কতটুকু দেখিয়া ভোল । নির্বোধ ! অন্ধ ! বিহারী উঠিয়া দাড়াইয়া কহিল, “আজ তুমি আমাকে স্বাহ শুনাইবে সমস্তই আমি শুনিব— কিন্তু যে-কথা বলিবার নহে, সে কথা বলিয়ে না, তোমার কাছে আমার এই একান্ত মিনতি ।” বিনোদিনী। ঠাকুরপো, কোথায় তোমার ব্যথা লাগিতেছে, তাহা আমি জানি— কিন্তু যাহার শ্রদ্ধা আমি পাইয়াছিলাম এবং যাহার ভালোবাসা পাইলে আমার জীবন সার্থক হইত, তাহার কাছে এই রাত্রে ভয়-লজ্জা সমস্ত বিসর্জন দিয়া ছুটিয়া আসিলাম, সে যে কতবড়ো বেদনায় তাহা মনে করিয়া একটু ধৈর্য ধরে। আমি সত্যই বলিতেছি, তুমি যদি আশাকে ভালো না বাসিতে, তবে আমার দ্বারা আশার আজ এমন সর্বনাশ হইত না ।” বিহার বিবর্ণ হইয়া কহিল, "আশার কী হইয়াছে। তুমি তাহার কী করিয়াছ ।”