পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8、Q উতলা হইয়া উঠিয়াছে। বিহারী চন্দ্রোদয়হীন অন্ধকারে ছাদে একখানি কেদারা লইয়া বসিয়া আছে । বালক বসন্তকে আজ সন্ধ্যাবেলায় সে পড়ায় নাই— সকাল সকাল তাহাকে বিদায় করিয়া দিয়াছে। আজ সাস্বনার জন্ত, সঙ্গের জন্য, তাহার চিরাভ্যস্ত প্রতিস্থধাগ্নিগ্ধ পূর্বজীবনের জন্য তাহার হৃদয় যেন মাতৃপরিত্যক্ত শিশুর মতো বিশ্বের অন্ধকারের মধ্যে দুই বাহু তুলিয়া কাহাকে খুজিয়া বেড়াইতেছে। আজ তাহার দৃঢ়তা, তাহার কঠোর সংযমের বাধ কোথায় ভাঙিয়া গেছে । যাহাদের কথা ভাবিবে না পণ করিয়াছিল, সমস্ত হৃদয় তাহাদের দিকে ছুটিয়াছে, আজ আর পথরোধ করিবার লেশমাত্র বল নাই । মহেক্সের সহিত বাল্যকালের প্রণয় হইতে সেই প্রণয়ের অবসান পর্যস্ত সমস্ত কথা — যে স্থদীর্ঘ কাহিনী নানাবর্ণে চিত্রিত, জলে-স্থলে পর্বতে নদীতে বিভক্ত মানচিত্রের মতো তাহার মনের মধ্যে গুটানো ছিল— বিহারী প্রসারিত করিয়া ধরিল । যে ক্ষুদ্র জগৎটুকুর উপর সে তাহার জীবনের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল, তাহা কোনখানে কোন দুগ্রহের সহিত সংঘাত পাইল, তাহাই সে মনে করিয়া দেখিতে লাগিল। প্রথমে বাহির হইতে কে আসিল । স্বর্ধাস্ত কালের করুণ রক্তিমছটায় আভাসিত আশার লজ্জামণ্ডিত তরুণ মুখখানি অন্ধকারে অঙ্কিত হইয়া উঠিল, তাহার সঙ্গে-সঙ্গে মঙ্গলউৎসবের পুণ্যশঙ্খধ্বনি তাহার কানে বাজিতে লাগিল। এই শুভগ্রহ অদৃষ্টাকাশের অজ্ঞাত প্রাস্ত হইতে আসিয়া দুই বন্ধুর মাঝখানে দাড়াইল— একটু যেন বিচ্ছেদ আনিল, কোথা হইতে এমন একটি গৃঢ় বেদনা আনিয়া উপস্থিত করিল, যাহা মুখে বলিবার নহে, যাহা মনেও লালন করিতে নাই । কিন্তু তবু এই বিচ্ছেদ, এই বেদনা অপূর্ব স্নেহরঞ্জিত মাধুর্যরশ্মির দ্বারা আচ্ছন্ন পরিপূর্ণ হইয়া রহিল। তাহার পরে যে শনিগ্রহের উদয় হইল—বন্ধুর প্রণয়, দম্পতির প্রেম, গৃহের শাত্তি ও পবিত্রতা একেবারে ছারখার করিয়া দিল, বিহারী প্রবল ঘৃণায় সেই বিনোদিনীকে । সমস্ত অন্তঃকরণের সহিত স্থদুরে ঠেলিয়া ফেলিতে চেষ্টা করিল। কিন্তু এ কী আশ্চৰ । আঘাত ষেন অত্যন্ত মৃদু হইয়া গেল, তাহাকে যেন স্পর্শ করিল না। সেই পরমা স্বন্দরী প্রহেলিকা তাহার দুর্তেস্তরহস্তপূর্ণ ঘনকৃষ্ণ অনিমেষ দৃষ্টি লইয়া কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারে বিহারীর সম্মুখে স্থির হইয়া দাড়াইল । গ্রীষ্মরাত্রির উচ্ছ্বসিত দক্ষিণ-বাতাস তাহারই ঘন নিশ্বাসের মতো বিহারীর গায়ে আসিয়া পড়িতে লাগিল। ধীরে ধীরে সেই পলকহীন চক্ষুর জালাময়ী দীপ্তি মান হইয়া আসিতে লাগিল ; সেই তৃষাণ্ডক খর দৃষ্টি অশ্রুজলে সিক্ত স্নিগ্ধ হইয়া গভীর ভাবরসে দেখিতে দেখিতে পরিপ্লুত হইয়া উঠিল, মুহূর্তের মধ্যে সেই মূর্তি বিহারীর পায়ের কাছে পড়িয়া তাহার দুই জায় প্রাণপণ বলে