পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8 OS গ্রামবাসী সকলের কাছ হইতে বিনোদিনী নিজেকে নির্লিপ্ত করিয়া লইতে চেষ্টা করিল। পল্লীর লোকেরা তাহাতে আরও রাগ করিল। পাতকিনীকে কাছে লইয়া ঘৃণা ও পীড়ন করিবার বিলাসমুখ হইতে তাহারা বঞ্চিত হইতে চায় না । ক্ষুদ্র পল্লীর মধ্যে নিজেকে সকলের কাছ হইতে গোপনে রাখিবার চেষ্টা বৃথা । এখানে আহত হৃদয়টিকে কোণের অন্ধকারে লইয়া নির্জনে শুশ্রীবা করিবার অবকাশ নাই– যেখান-সেখান হইতে সকলের তীক্ষ কৌতুহলদৃষ্টি আসিয়া ক্ষতস্থানে পতিত হয়। বিনোদিনীর অন্তঃপ্রকৃতি চুপড়ির ভিতরকার সজীব মাছের মতো যতই আছড়াইতে লাগিল, ততই চারিদিকের সংকীর্ণতার মধ্যে নিজেকে বারংবার আহত করিতে লাগিল । এখানে স্বাধীনভাবে পরিপূর্ণরূপে বেদনাভোগ করিবারও স্থান নাই । দ্বিতীয় দিনে চিঠি পাইবার সময় উত্তীর্ণ হইতেই বিনোদিনী ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া লিখিতে বসিল— ঠাকুরপো, ভয় করিয়া না, আমি তোমাকে প্রেমের চিঠি লিখিতে বসি নাই। তুমি আমার বিচারক, আমি তোমাকে প্রণাম করি। আমি ষে পাপ করিয়াছি, তুমি তাহার কঠিন দণ্ড দিয়াছ ; তোমার আদেশমাত্র সে দণ্ড আমি মাথায় করিয়া বহন করিয়াছি । দুঃগ এই, দগুটি যে কত কঠিন, তাহা তুমি দেখিতে পাইলে না। যদি দেখিতে, যদি জানিতে পাইতে, তাহা হইলে তোমার মনে যে-দয়া হইত তাহা হইতেও বঞ্চিত হইলাম । তোমাকে স্মরণ করিয়া, মনে মনে তোমার দুইখানি পায়ের কাছে মাথা রাখিয়া, আমি ইহাও সহ্য করিব । কিন্তু প্রভু, জেলখানার কয়েদি কি আহারও পায় না। শৌখিন আহার নহে— যতটুকু না হইলে তাহার প্রাণ বঁাচে না, সেটুকুও তো বরাদ্দ আছে। তোমার দুই ছত্র চিঠি আমার এই নির্বাসনের আহার— তাহা যদি না পাই, তবে আমার কেবল নির্বাসনদও নহে, প্রাণদণ্ড । আমাকে এত অধিক পরীক্ষণ করিয়ো না, দণ্ডদাতা । আমার পাপমনে অহংকারের সীমা ছিল না— কাহারও কাছে আমাকে এমন করিয়া মাথা নোয়াইতে হইবে, ইহা আমি স্বপ্নেও জানিতাম না । তোমার জয় হইয়াছে, প্রভু ; আমি বিদ্রোহ করিব না । কিন্তু আমাকে দয়া করো— আমাকে বাচিতে দাও । এই অরণ্যবাসের সম্বল আমাকে অল্প-একটু করিয়া দিয়ো । তাহা হইলে তোমার শাসন হইতে আমাকে কেহই কিছুতেই টলাইতে পারিবে না। এইটুকু দুঃখের