পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8లి: মহেন্দ্ৰ পায়চারি ভঙ্গ করিয়া কী বলিবার জন্য হঠাৎ আশার কাছে আসিয়৷ দাড়াইল । সমস্ত শরীরের রক্ত আশার কানের মধ্যে গিয়া শব্দ করিতে লাগিল, সে চক্ষু মুদ্রিত করিল। মহেন্দ্র কী বলিতে আসিয়াছিল, ভাবিয়া পাইল না, তাহার কীই বা বলিবার আছে। কিন্তু কিছু-একটা না বলিয়া আর ফিরিতে পারিল না। বলিল, “চাবির গোছাটা কোথায় ।” চাবির গোছা ছিল বিছানার গদিটার নিচে । আশা উঠিয়া ঘরের মধ্যে গেল— মহেন্দ্র তাহার অনুসরণ করিল । গদির নিচে হইতে চাবি বাহির করিয়া আশা গদির উপরে রাখিয়া দিল । মহেন্দ্র চাবির গোছা লইয়া নিজের কাপড়ের আলমারিতে এক-একটি চাবি লাগাইয়া দেখিতে লাগিল । আশা আর থাকিতে পারিল না, মৃদুস্বরে কহিল, “ও-আলমারির চাবি আমার কাছে ছিল না।” কাহার কাছে চাবি ছিল সে-কথা আশার মুখ দিয়া বাহির হইল না, কিন্তু মহেন্দ্র তাহা বুঝিল । আশা তাড়াতাড়ি ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল, ভয় হইল, পাছে মহেন্দ্রের কাছে আর তাহার কান্না চাপা না থাকে। অন্ধকারে ছাদের প্রাচীরের এক কোণে মুখ ফিরাইয়া দাড়াইয়া উচ্ছ্বসিত রোদনকে প্রাণপণে রুদ্ধ করিয়া সে কাদিতে লাগিল । কিন্তু অধিকক্ষণ কাদিবার সময় ছিল না। হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল, মহেক্সের আহারের সময় হইয়াছে। দ্রুতপদে আশা নিচে চলিয়া গেল । রাজলক্ষ্মী আশাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহিন কোথায়, বউমা ।” আশা কহিল, “তিনি উপরে ।” রাজলক্ষ্মী। তুমি নামিয়া আসিলে যে। আশা নতমুখে কহিল, “তাহার খাবার—” রাজলক্ষ্মী । খাবারের আমি ব্যবস্থা করিতেছি, বউমা, তুমি একটু পরিষ্কার হইয়া লও। তোমার সেই নূতন ঢাকাই শাড়িখানা শীঘ্র পরিয়া আমার কাছে এসো, আমি তোমার চুল বাধিয়া দিই। শাশুড়ীর আদর উপেক্ষা করিতে পারে না, কিন্তু এই সাজসজ্জার প্রস্তাবে আশা মরমে মরিয়া গেল । মৃত্যু ইচ্ছা করিয়া ভীষ্ম যেরূপ স্তন্ধ হইয়া শরবর্ষণ সহ করিয়াছিলেন, আশাও সেরূপ রাজলক্ষ্মীর কৃত সমস্ত প্রসাধন পরমধৈর্ষে সর্বাঙ্গে গ্রহণ করিল। সাজ করিয়া অাশা অতি ধীরে ধীরে নিঃশবপদে সিড়ি বাহিয়া উপরে উঠিল । উকি দিয়া দেখিল, মহেন্দ্র ছাদে নাই । আস্তে-আস্তে দ্বারের কাছে আসিয়া দেখিল, মহেন্দ্র ঘরেও নাই, তাহার খাবার অভুক্ত পড়িয়া আছে।