পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 e রবীন্দ্র-রচনাবলী চাবির অভাবে কাপড়ের আলমারি জোর করিয়া খুলিয়া আবশ্বক কয়েকখান কাপড় ও ডাক্তারি বই লইয়া মহেন্দ্র চলিয়া গেছে । পরদিন একাদশী ছিল । অসুস্থ :ক্লিষ্টদেহ রাজলক্ষ্মী বিছানায় পড়িয়া ছিলেন । বাহিরে ঘন মেঘে ঝড়ের উপক্রম করিয়াছে। আশা ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। আস্তে-আস্তে রাজলক্ষ্মীর পায়ের কাছে বসিয়া তাহার পায়ে হাত দিয়া কহিল, "তোমার দুধ ও ফল আনিয়াছি মা, খাবে এসো।” করুণমূতি বধূর এই অনভ্যস্ত সেবার চেষ্টা দেখিয়া রাজলক্ষ্মীর শুষ্ক চক্ষু প্লাবিত হইয়া গেল । তিনি উঠিয়া বসিয়া আশাকে কোলে লইয়া তাহার অশ্রীজলসিক্ত কপোল চুম্বন করিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহিন, এখন কী করিতেছে বউম৷ ” আশা অত্যন্ত লজ্জিত হইল— মৃদুস্বরে কহিল, “তিনি চলিয়া গেছেন।” রাজলক্ষ্মী। কখন চলিয়া গেল, আমি তো জানিতেও পারি নাই । আশা নতশিরে কহিল, “তিনি কাল রাত্রেই গেছেন।” শুনিবামাত্র রাজলক্ষ্মীর সমস্ত কোমলতা যেন দূর হইয়া গেল— বধূর প্রতি র্তাহার আদরষ্পর্শের মধ্যে আর রসলেশমাত্র রহিল না । আশা একটা নীরব লাঞ্চনা অনুভব করিয়া নতমুখে আস্তে-আস্তে চলিয়া গেল । 80 প্রথম রাত্রে বিনোদিনীকে পটলডাঙার বাসায় রাখিয়া মহেন্দ্র যখন তাহার কাপড় ও বই আনিতে বাড়ি গেল, বিনোদিনী তখন কলিকাতার বিশ্রামবিহীন জনতরঙ্গের কোলাহলে একলা বসিয়া নিজের কথা ভাবিতেছিল। পৃথিবীতে তাহার আশ্রয়স্থান কোনোকালেই যথেষ্ট বিস্তীর্ণ ছিল না, তবু তাহার এক পাশ তাতিয়া উঠিলে আর একপাশে ফিরিয়া শুইবার একটুখানি জায়গা ছিল— আজ তাহার নির্ভরস্থল অত্যস্ত সংকীর্ণ। সে যে-নৌকায় চড়িয়া স্রোতে ভাসিয়াছে, তাহা দক্ষিণে বামে একটু কাত হইলেই একেবারে জলের মধ্যে গিয়া পড়িতে হইবে। অতএব বড়োই স্থির হইয়া হাল ধরা চাই, একটু ভুল, একটু নাড়াচাড়া সহিবে না। এ অবস্থায় কোন রমণীর হৃদয় না কম্পিত হয়। পরের মন, সম্পূর্ণ বশে রাখিতে যেটুকু লীলাখেলা চাই, যেটুকু অন্তরালের প্রয়োজন, এই সংকীর্ণতার মধ্যে তাহার অবকাশ কোথায় । একেবারে মহেঞ্জের সহিত মুখোমুখি করিয়া তাহাকে সমস্ত জীবন যাপন করিতে প্রস্তুত হইতে হইবে। প্রভেদ এই যে, মহেঞ্জের কুলে উঠিবার উপায় আছে, কিন্তু বিনোদিনীর তাহা নাই ।