পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

3$9e রবীন্দ্র-রচনাবলী আশা নিস্তব্ধ হইয়া ভাবিতে লাগিল । রাজলক্ষ্মী নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, *সে যদি খবর পায় আমার ব্যামো হইয়াছে, তবে সে না জাসিয়া থাকিতে পারিবে না ।” আশা বুঝিল, রাজলক্ষ্মীর ইচ্ছা বিহার এই খবরটা পায়। বিহারীর অভাবে তিনি আজকাল একেবারে নিরাশ্রয় হইয়া পড়িয়াছেন । ঘরের আলো নিবাইয়া দিয়া মহেন্দ্র জ্যোৎস্নায় জানলার কাছে চুপ করিয়া দাড়াইয়া ছিল । পড়িতে আর ভালো লাগে না । গৃহে কোনো স্থখ নাই । যাহারা পরমাত্মীয়, তাহাদের সঙ্গে সহজভাবের সম্বন্ধ দূর হইয়া গেলে, তাহাদিগকে পরের মতো অনায়াসে ফেলিয়া দেওয়া যায় না, আবার প্রিয়জনের মতো অনায়াসে তাহাদিগকে গ্রহণ করা যায় না—তাহীদের সেই অত্যাজ্য আত্মীয়তা অহরহ অসহ ভারের মতো বক্ষে চাপিয়া থাকে। মার সম্মুখে যাইতে মহেন্দ্রের ইচ্ছা হয় না— তিনি হঠাৎ মহেন্দ্রকে কাছে জালিতে দেখিলেই এমন একটা শঙ্কিত উদবেগের সহিত তাহার মুখের দিকে চান যে, মহেন্দ্রকে তাহা আঘাত করে। আশা কোনো উপলক্ষে কাছে আসিলে তাহার সঙ্গে কথা কহাও কঠিন হয়, চুপ করিয়া থাকাও কষ্টকর হইয়া উঠে। এমন করিয়া দিন আর কাটিতে চাহে না । মহেন্দ্র দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, অন্তত সাত দিন সে বিনোদিনীর সঙ্গে একেবারেই দেখা করিবে না। আরো দুই দিন বাকি আছে—কেমন করিয়া সে দুই দিন কাটিবে। মহেন্দ্র পশ্চাতে পদশব্দ শুনিল । বুঝিল, আশা ঘরে প্রবেশ করিয়াছে। যেন শুনিতে পায় নাই, এই ভান করিয়া স্থির হইয়া দাড়াইয়া রহিল। আশা সে ভানটুকু বুঝিতে পারিল, তবু ঘর হইতে চলিয়া গেল না। পশ্চাতে দাড়াইয়া কহিল, “একটা কথা আছে, সেইটে বলিয়াই আমি যাইতেছি ।” মহেন্দ্র ফিরিয়া কহিল, “যাইতে হইবে কেন, একটু বসোই না ।” আশা এই ভদ্রতাটুকুতে কান না দিয়া স্থির দাড়াইয়া কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপোকে মার অমুখের খবর দেওয়া উচিত।” বিহারীর নাম শুনিয়াই মহেঞ্জের গভীর হৃদয়ক্ষতে ঘা পড়িল । নিজেকে একটুখানি সামলাইয়া লইয়া কহিল, "কেন উচিত। আমার চিকিৎসায় বুঝি বিশ্বাস হয় না।” মহেন্দ্র মাতার চিকিৎসায় যথোচিত যত্ন করিতেছে না, এই ভৎসনায় আশার হৃদয় পরিপূর্ণ হইয়া ছিল, তাই তাহার মুখ দিয়া বাহির হইল, “কই, মার ব্যামো তো কিছুই ভালো হয় নাই, দিনে দিনে আরও যেন বাড়িয়া উঠিতেছে।” এই সামান্ত কথাটার ভিতরকার উত্তাপ মহেন্দ্ৰ বুঝিতে পারিল। এমন গৃঢ়