পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি ৪৭৯ রাজলক্ষ্মীর হঠাৎ কী মনে পড়িল— তিনি ভাকিলেন, “বউমা, ও বউমা ।” আশা ঘরে প্রবেশ করিতেই কহিলেন, "বেহারির খাবারের সব ব্যবস্থা করিয়ান্ত তো ।” বিহারী কহিল, “মা, তোমার এই পেটুক ছেলেটিকে সকলেই চিনিয়া লইয়াছে । দেউড়িতে ঢুকিতেই দেখি, ডিমওয়ালা বড়ো বড়ো কইমাছ চুপড়িতে লইয়া বামি হনহন করিয়া অন্দরের দিকে ছুটিয়াছে— বুঝিলাম, এ-বাড়িতে এখনো আমার খ্যাতি লুপ্ত হয় নাই ।” বলিয়া বিহার হাসিয়া একবার আশার মুখের দিকে छांश्लि । আশা আজ আর লজ্জা পাইল না । সে স্নেহের সহিত স্মিতহাস্তে বিহারীর পরিহাস গ্রহণ করিল। বিহার যে এ-সংসারের কতখানি, আশা তাহ আগে সম্পূর্ণ জানিত না ;– অনেক সময় তাহাকে অনাবশ্যক আগন্তুক মনে করিয়া অবজ্ঞা করিয়াছে, অনেক সময় বিহারীর প্রতি বিমুখভাব তাহার আচরণে স্থম্পষ্ট পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে ; সেই অনুতাপের ধিক্কারে আজ বিহারীর প্রতি তাহার শ্রদ্ধা এবং করুণা সবেগে ধাবিত হইয়াছে। রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “মেজবউ, বামুনঠাকুরের কর্ম নয়, রান্নাটা তোমায় নিজে দেখাইয়া দিতে হইবে— আমাদের এই বাঙাল ছেলে একরাশ ঝাল নহিলে খাইতে পারে না । বিহারী । তোমার মা ছিলেন বিক্রমপুরের মেয়ে, তুমি নদীয়া জেলার ভয় সন্তানকে বাঙাল বল ? এ তো আমার সহ হয় না । ইহা লইয়া অনেক পরিহাস হইল, এবং অনেক দিন পরে মহেঞ্জের ' বাড়ির বিষাদভার যেন লঘু হইয়া আসিল । কিন্তু এত কথাবার্তার মধ্যে কোনো পক্ষ হইতে কেহ মহেঞ্জের নাম উচ্চারণ করিল না । পূর্বে বিহারীর সঙ্গে মহেঞ্জের কথা লইয়াই রাজলক্ষ্মীর একমাত্র কথা ছিল। . তাহা লইয়া মহেন্দ্র নিজে তাহার মাতাকে অনেকবার পরিহাস করিয়াছে । আজ সেই রাজলক্ষ্মীর মুখে মহেন্দ্রের নাম একবারও না শুনিয়া বিহারী মনে মনে স্তম্ভিত হইল । রাজলক্ষ্মীর একটু নিদ্রাবেশ হইতেই বিহারী বাহিরে আসিয়া অন্নপূর্ণাকে কহিল, “মার ব্যামো তো সহজ নহে ।” অন্নপূর্ণ কছিলেন, “সে তো স্পষ্টই দেখা যাইতেছে।” বলিয়া তাহার ঘরের জানালার কাছে বসিয়া পড়িলেন । ।