পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

too রবীন্দ্র-রচনাবলী ৰাহা হউক, আমাদের চিত্ত যদি সকল বিষয়ে সতেজ সক্রিয় থাকিত তাহা হইলে বিলাত আমাদের সে-চিত্তকে বিহ্বল করিয়া দিতে পারিত না । দুৰ্ভাগ্যক্রমে ইংরেজ যখন তাহার কলবল, তাহার বিজ্ঞান-দর্শন লইয়া আমাদের স্বারে আসিয়া পড়িল তখন আমাদের চিত্ত নিশ্চেষ্ট ছিল । যে-তপস্তার প্রভাবে ভারতবর্ষ জগতের গুরুপদে আসীন হইয়াছিল সেই তপস্যা তখন ক্ষান্ত ছিল । আমরা তখন কেবল মাঝে মাঝে পুথি রৌদ্রে দিতেছিলাম এবং গুটাইয়া ঘরে তুলিতেছিলাম। আমরা কিছুই করিতেছিলাম না। আমাদের গৌরবের দিন বহুদূরপশ্চাতে দিগন্তরেখায় ছায়ার মতো দেখা যাইতেছিল । সম্মুখের পুষ্করিণীর পাড়িও সেই পর্বতমালার চেয়ে বৃহৎরুপে সত্যরূপে প্রত্যক্ষ হয়। যাহা হউক, আমাদের মন যখন নিশ্চেষ্ট নিক্রিয় সেই সময়ে একটা সচেষ্ট শক্তি, শুষ্ক জ্যৈষ্ঠের সম্মুখে আষাঢ়ের মেঘাগমের ন্যায়, তাহার বজ্রবিদ্যুৎ, বায়ুবেগে ও বারিবর্ষণ লইয়া অকস্মাৎ দিগ দিগন্তু বেষ্টন করিয়া দেখা দিল । ইহাতে অভিভূত করিবে না কেন । আমাদের বাচিবার উপায় আমাদের নিজের শক্তিকে সর্বতোভাবে জাগ্রত করা । আমরা যে আমাদের পূর্বপুরুষের সম্পত্তি বসিয়া বসিয়া ফুকিতেছি, ইহাই আমাদের গৌরব নহে ; আমরা সেই ঐশ্বৰ্ষ বিস্তার করিতেছি, ইহাই যখন সমাজের সর্বত্র আমরা উপলব্ধি করিব তখনই নিজের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা সঞ্জাত হইয়া আমাদের মোহ ছুটিতে থাকিবে । আমাদের এই নিক্রিয় নিশ্চেষ্ট অবস্থা কেন ঘটিয়াছে, আমার প্রবন্ধে তাহার কারণ দেখাইয়াছি। তাহার কারণ ভীরুতা। আমাদের যাহা-কিছু ছিল তাঁহারই মধ্যে কুঞ্চিত হইয়া থাকিবার চেষ্টাই বিদেশী সভ্যতার আঘাতে আমাদের অভিভূত হইবার কারণ। - কিন্তু, প্রথমে যাহা আমাদিগকে অভিভূত করিয়াছিল তাহাই আমাদিগকে জাগ্ৰত করিতেছে। প্রথম স্বপ্তিভঙ্গে যে প্রখর আলোক চোখে ধাঁধা লাগাইয়া দেয় তাহাই ক্রমশ আমাদের দৃষ্টিশক্তির সহায়তা করে। এখন আমরা সজাগভাবে সজ্ঞানভাবে নিজের দেশের আদর্শকে উপলব্ধি করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি । বিদেশী আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজের দেশের গৌরবকে বৃহৎভাবে প্রত্যক্ষভাবে দেখিতেছি । এখন এই আদর্শকে কী করিয়া বাচানো যাইবে, সেই ব্যাকুলত নানাপৰাচুসন্ধানে আমাদিগকে প্রবৃত্ত করিতেছে। যেমন আছি ঠিক তেমনি বলিয়া থাকিলেই যদি সমস্ত রক্ষণ পাইত, তবে প্রতিদিন পদে পদে আমাদের এমন দুৰ্গতি ঘটিত না ।