পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আত্মশক্তি @> আপনাকে পরিতৃপ্ত করে, সে একদিন এমন কঠিনহৃদয় হইয় উঠে যে, উপবাসী স্বদেশকে যদি স্থদুরপথে দেখে, তবে টাকা ভাঙাইয়া লিকিটি বাহির করিবার ভয়ে দ্বার রুদ্ধ করিয়া দেয়। ইহার কারণ এই যে, শুদ্ধমাত্র ভাব যত বড়োই হউক, ক্ষুদ্রতম প্রত্যক্ষবস্তুর কাছে তাহাকে পরাস্ত হইতে হইবে । এইজন্যই বলিতেছিলাম, যাহা আমরা পুথি হইতে পড়িয়া পাইয়াছি, যাহাকে আমরা ভাবসম্ভোগ বা অহংকার তৃপ্তির উপায়স্বরূপ করিয়া রসালসঙ্গড়ত্বের মধ্যে উপস্থিত হইয়াছি ও ক্রমে অবসাদের মধ্যে অবতরণ করিতেছি, তাহাকে প্রত্যক্ষতার মূতি, বাস্তবিকতার গুরুত্ব দান করিলে তবে আমরা রক্ষা পাইব । শুধু বড়ো জিনিস কল্পনা করিলেও হইবে না, বড়ো দান ভিক্ষা করিলেও হইবে না এবং ছোটো মুখে বড়ো কথা বলিলেও হইবে না, স্বারের পাশ্বে নিতান্ত ছোটো কাজ শুরু করিতে হুইবে । বিলাতের প্রাসাদে গিয়া রোদন করিলে হইবে না, স্বদেশের ক্ষেত্রে বসিয়া কণ্টক উৎপাটন করিতে হইবে । ইহাতে আমাদের শক্তির চর্চা হইবে— সেই শক্তির চর্চামাত্রেই স্বাধীনতা, এবং স্বাধীনতামাত্রেই আনন্দ । আজ তোমাদের তারুণ্যের মধ্যে আমার অবারিত প্রবেশাধিকার নাই, তোমাদের আশা আকাঙ্ক্ষা আদর্শ যে কী, তাহা স্পষ্টরূপে অনুভব করা আজ আমার পক্ষে অসম্ভব— কিন্তু, নিজেদের নবীন কৈশোরের স্মৃতিটুকুও তো ভস্মাবৃত অগ্নিকণার মতো পককেশের নিচে এখনো প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে । সেই স্মৃতির বলে ইহা নিশ্চয় জানিতেছি যে, মহৎ আকাঙ্ক্ষার রাগিণী মনে যে-তারে সহজে বাজিয়া উঠে তোমাদের অন্তরের সেই সূক্ষ্ম সেই তীক্ষু সেই প্রভাতসূর্যরশ্মি-নির্মিত তত্ত্বর ন্যায় উজ্জল তন্ত্রীগুলিতে এখনো অব্যরহারের মরিচা পড়িয়া যায় নাই— উদার উদ্দেশ্যের প্রতি নির্বিচারে আত্মবিসর্জন করিবার দিকে মানুষের মনের যে একটা স্বাভাবিক ও স্বগভীর প্রেরণা আছে, তোমাদের অস্তঃকরণে এখনো তাহা ক্ষুদ্র বাধার দ্বারা বারংবার প্রতিহত হইয়া নিস্তেজ হয় নাই ; আমি জানি, স্বদেশ যখন অপমানিত হয় আহত অগ্নির ন্যায় তোমাদের হৃদয় উদ্দীপ্ত হইয়া উঠে—নিজের ব্যবসায়ের সংকীর্ণতা ও স্বার্থসাধনের চেষ্টা তোমাদের সমস্ত মনকে গ্রাস করে নাই ; দেশের অভাব ও অগৌরব ষে কেমন করিয়া দূর হইতে পারে, সেই চিন্তা নিশ্চয়ই মাঝে মাঝে তোমাদের রজনীর বিনিদ্র প্রহর ও দিবসের নিভৃত অবকাশকে আক্রমণ করে— আমি জানি, ইতিহাসবিশ্রত যে-সকল মহাপুরুষ দেশহিতের জন্য লোকহিতের জন্য আপনাকে উৎসর্গ করিয়া মৃত্যুকে পরাস্ত, স্বার্থকে লজ্জিত ও দুঃখক্লেশকে অমর মহিমায় সমুজ্জল করিয়া গেছেন, তাহাদের দৃষ্টান্ত তোমাদিগকে যখন আহবান করে তখন তাহাকে আজও তোমরা বিজ্ঞ বিষয়ীর মতো