পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Sobr রবীন্দ্র-রচনাবলী ব্ৰজমোহন কহিলেন, “এমন কিছু গুরুতর নহে ।” তবে এত তাগিদ কেন, সেটুকু শুনিবার জন্য রমেশ পিতার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, সে কৌতুহল-নিবৃত্তি করা তিনি আবশ্যক বােধ করিলেন না। ব্ৰজমোহনবাবু সন্ধ্যার সময় যখন তাহার কলিকাতার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করিতে বাহির হইলেন, তখন রমেশ ঠাহাকে একটা পত্র লিখিতে বসিল। ‘শ্ৰীচরণকমলেষু পর্যন্ত লিখিয়া লেখা আর অগ্রসর হইতে চাহিল না। কিন্তু রমেশ মনে মনে কহিল, “আমি হেমনলিনী সম্বন্ধে যে অনুচ্চারিত সতো আবদ্ধ হইয়া পড়িয়াছি, বাবার কাছে আর তাহা গোপন করা কোনোমতেই উচিত হইবে না।" অনেকগুলো চিঠি অনেক রকম করিয়া লিখিল- সমস্তই সে ছিড়িয়া ফেলিল । ব্ৰজমোহন আহার করিয়া আরামে নিদ্ৰা দিলেন। রমেশ বাড়ির ছাদের উপর উঠিয়া প্রতিবেশীর বাড়ির দিকে তাকাইয়া নিশাচরের মতো সবেগে পায়চারি করিতে লাগিল । রাত্রি নয়টার সময় অক্ষয় অন্নদাবাবুর বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গেল— রাত্রি সাড়ে-নয়টার সময় সাড়ে-দশটার পর সে-বাড়ির কক্ষে কক্ষে সুগভীর সুষুপ্তি বিরাজ করিতে লাগিল । পরদিন ভোরের ট্রেনে রমেশকে রওনা হইতে হইল। ব্ৰজমোহনবাবুর সতর্কতায় গাড়ি ফেল করিবার কোনোই সুযোগ উপস্থিত হইল না। ܔ বাড়ি গিয়া রমেশ খবর পাইল, তাহার বিবাহের পাত্রী ও দিন স্থির হইয়াছে। তাহার পিতা ব্ৰজমোহনের বাল্যবন্ধু ঈশান যখন ওকালতি করিতেন, তখন ব্ৰজমোহনের অবস্থা ভালো ছিল না— ঈশানের সহায়তাতেই তিনি উন্নতিলাভ করিয়াছেন । সেই ঈশান যখন অকালে মারা পড়িলেন, তখন দেখা গেল তাহার সঞ্চয় কিছুই নাই, দেনা আছে। বিধবা স্ত্রী একটি শিশুকন্যাকে লইয়া দারিদ্র্যের মধ্যে ডুবিয়া পড়িলেন । সেই কন্যাটি আজ বিবাহযোগ্য হইয়াছে, ব্ৰজমোহন তাহারই সঙ্গে রমেশের বিবাহ স্থির করিয়াছেন । রমেশের হিতৈষীরা কেহ কেহ আপত্তি করিয়া বলিয়াছিল যে, শুনিয়াছি মেয়েটি দেখিতে তেমন ভালো নয় । ব্ৰজমোহন কহিলেন, “ও-সকল কথা আমি ভালো বুঝি নামানুষ তো ফুল কিংবা প্রজাপতি মাত্র নয় যে, ভালো দেখার বিচারটাই সর্বাগ্ৰে তুলিতে হইবে । মেয়েটির মা যেমন সতী-সাধবী, মেয়েটিও যদি তেমনি হয়, তবে রমেশ যেন তাহাই ভাগ্য বলিয়া জ্ঞান করে ।” শুভবিবাহের জনশ্রুতিতে রমেশের মুখ শুকাইয়া গেল । সে উদাসের মতো ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল । নিষ্কৃতিলাভের নানা প্রকার উপায় চিন্তা করিয়া কোনোটাই তাহার সম্ভবপর বোধ হইল না । শেষকালে বহুকষ্টে সংকোচ দূর কবিয়া পিতাকে গিয়া কহিল, “বাবা, এ বিবাহ আমার পক্ষে অসাধা । আমি অন্য স্থানে পণে আবদ্ধ হইয়াছি। ” ব্ৰজমোহন । বল কী ! একেবারে পানপত্র হইয়া গেল ? রমেশ । না, ঠিক পানপত্র নয়, তবে— ব্ৰজমোহন । কন্যােপক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা সব ঠিক হইয়া গেছে ? রমেশ । না, কথাবার্তা যাহাকে বলে তাহা হয় নাই— ব্ৰজমোহন 1 হয় নাই তো ! তবে এতদিন যখন চুপ করিয়া আছ, তখন আর কােটা দিন চুপ করিয়া গেলেই হইবে । রমেশ একটু নীরবে থাকিয়া কহিল, “আর কোনো কন্যাকে আমার পত্নীরূপে গ্ৰহণ করা অন্যায় হইবে ।” ব্ৰজমোহন কহিলেন, “না-করা তোমার পক্ষে আরো বেশি অন্যায় হইতে পারে।”