পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

2> O রবীন্দ্র-রচনাবলী VO) কুহেলিকা কাটিয়া গেছে। বহুদূরব্যাপী মরুময় বালুভূমিকে নির্মল জ্যোৎস্না বিধবার শুভ্ৰবসনের মতো আচ্ছন্ন করিয়াছে। নদীতে নীেকা ছিল না, ঢেউ ছিল না, রোগযন্ত্রণার পরে মৃত্যু যেরূপ নির্বিকার শান্তি বিকীর্ণ করিয়া দেয়, সেইরূপ শান্তি জলে স্থলে স্তব্ধভাবে বিরাজ করিতেছে। সংজ্ঞােলাভ করিয়া রমেশ দেখিল, সে বালির তটে পড়িয়া আছে। কী ঘটিয়াছিল, তাহা মনে করিতে তাহার কিছুক্ষণ সময় গেল— তাহার পরে দুঃস্বপ্নের মতো সমস্ত ঘটনা তাহার মনে জাগিয়া উঠিল । তাহার পিতা ও অন্যান্য আত্মীয়গণের কী দশা হইল সন্ধান করিবার জন্য সে উঠিয়া পড়িল । চারি দিকে চাহিয়া দেখিল, কোথাও কাহারও কোনো চিহ্ন নাই। বালুতটের তীর বাহিয়া সে খুঁজিতে খুঁজিতে চলিল । পদ্মার দুই শাখাবাহুর মাঝখানে এই শুভ্র দ্বীপটি উলঙ্গ শিশুর মতো উর্ধ্বমুখে শয়ন রহিয়াছে। রমেশ যখন একটি শাখার তীর্যপ্রাপ্ত ঘুরিয়া অন্য শাখার তীরে গিয়া উপস্থিত হইল, তখন কিছুদূরে একটা লাল কাপড়ের মতো দেখা গেল। দ্রুতপদে কাছে আসিয়া রমেশ দেখিল, লাল-চেলি-পরা নববধূটি প্রাণহীনভাবে পড়িয়া আছে। জলমগ্ন মুমূর্ষর শ্বাসক্রিয়া কিরূপ কৃত্রিম উপায়ে ফিরাইয়া আনিতে হয়, রমেশ তাহা জানিত । তাহার পেটের উপর চাপিয়া ধরিতে লাগিল। ক্রমে ক্রমে বধূর নিশ্বাস বহিল এবং সে চক্ষু মেলিল । রমেশ তখন অত্যন্ত শ্ৰান্ত হইয়া কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। বালিকাকে কোনো প্রশ্ন করিবে, সেটুকু শ্বাসও যেন তাহার আয়ত্তের মধ্যে ছিল না । বালিকা তখনো সম্পূৰ্ণ জ্ঞানলাভ করে নাই। একবার চােখ মেলিয়া তখনই তাহার চোখের পাতা মুদিয়া আসিল । রমেশ পরীক্ষা করিয়া দেখিল, তাহার শ্বাসক্রিয়ার আর কোনো ব্যাঘাত নাই। তখন এই জনহীন জলস্থলের সীমায় জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে সেই পাণ্ডুর জোৎস্নালোকে রমেশ বালিকার মুখের দিকে অনেকক্ষণ চাহিয়া রহিল । কে বলিল সুশীলাকে ভালো দেখিতে নয় ? এই নিমীলিতনেত্ৰ সুকুমার মুখখানি ছোটাে— তবু এতবড়ো আকাশের মাঝখানে, বিস্তীৰ্ণ জোৎস্নায়, কেবল এই সুন্দর কোমল মুখ একটিমাত্র দেখিবার জিনিসের মতো গৌরবে ফুটিয়া আছে। রমেশ আর-সকল কথা ভুলিয়া ভাবিল, “ইহাকে যে বিবাহসভায় কলরব ও জনতার মধ্যে দেখি নাই, সে ভালেই হইয়াছে । ইহাকে এমন করিয়া আর কোথাও দেখিতে পাইতাম না । ইহার মধ্যে নিশ্বাস সঞ্চার করিয়া বিবাহের মন্ত্রপাঠের চেয়ে ইহাকে অধিক আপনার করিয়া লইয়াছি । মন্ত্ৰ পডিয়া ইহাকে আপনার নিশ্চিত প্রাপাস্বরূপ পাইতাম, এখানে ইহাকে অনুকুল বিধাতার প্রসাদের স্বরূপ লাভ করিলাম । জ্ঞানলাভ করিয়া বধূ উঠিয়া বসিয়া শিথিল বস্ত্ৰ সারিয়া লইয়া মাথায় ঘোমটা তুলিয়া দিল। রমেশ জিজ্ঞাসা করিল, “তোমাদের নীেকার আর-সকলে কোথায় গেছেন, কিছু জান ?” সে কেবল নীরবে মাথা নাড়িল । রমেশ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি এইখানে একটুখানি বসিতে পরিবে ? আমি একবার চারি দিক ঘুরিয়া সকলের সন্ধান লইয়া আসিব ।” বালিকা তাহার কোনো উত্তর করিল না। কিন্তু তাহার সর্বশরীর যেন সংকুচিত হইয়া বলিয়া উঠিল, 'এখানে আমাকে একলা ফেলিয়া যাইয়ো না ।” রমেশ তাহা বুঝিতে পারিল । সে একবার উঠিয়া দাড়াইয়া চারি দিকে তাকাইল- সাদা বালির মধ্যে কোথাও কোনো চিহ্নমাত্ৰ নাই । আত্মীয়াদিগকে আহবান করিয়া প্ৰাণপণ উৰ্ব্বকণ্ঠে ডাকিতে লাগিল, কাহারও কোনো সাড়া পাওয়া গেল না । রমেশ বৃথা চেষ্টায় ক্ষান্ত হইয়া বসিয়া দেখিল— বধু মুখে দুই হাত দিয়া কান্না চাপিবার চেষ্টা