পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SS R রবীন্দ্র-রচনাবলী অপ্ৰগলভা মাতা রূপে তাহার ধাননেত্রের সম্মুখে বিচিত্রভাবে বিকশিত হইয়া উঠিয়াছে। চিত্রকর তাহার ভাবী চিত্রকে, কবি তাহার ভাবী কাব্যকে যেরূপ সম্পূর্ণ সুন্দরীরূপে কল্পনা করিয়া হৃদয়ের মধ্যে একান্ত আদরে লালন করিতে থাকে, রমেশ সেইরূপ এই ক্ষুদ্র বালিকাকে উপলক্ষমাত্র করিয়া ভাবী প্ৰেয়সীকে কল্যাণীকে পূর্ণমহীয়সী মূর্তিতে হৃদয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করিল। ( এইরূপে প্ৰায় তিন মাস অতীত হইয়া গেল। বৈষয়িক ব্যবস্থা সমস্ত সমাধা হইয়া আসিল । প্রাচীনারা তীৰ্থবাসের জন্য প্রস্তুত হইলেন। প্রতিবেশীমহল হইতে দুই-একটি সঙ্গিনী নববধূর সহিত পরিচয়স্থাপনের জন্য অগ্রসর হইতে লাগিল । রমেশের সঙ্গে বালিকার প্রণয়ের প্রথম গ্ৰন্থি অল্পে অল্পে আঁট হইয়া আসিল । এখন সন্ধ্যাবেলায় নির্জন ছাদে খোলা আকাশের তলে দুজনে মাদুর পাতিয়া বসিতে আরম্ভ করিয়াছে। রমেশ পিছন হইতে হঠাৎ বালিকার চোখ টিপিয়া ধরে, তাহার মাথাটা বুকের কাছে টানিয়া আনে, বধু যখন রাত্রি অধিক না হইতেই না খাইয়া ঘুমাইয়া পড়ে, রমেশ তখন নানাবিধ উপদ্রবে তাহাকে সচেতন করিয়া তাহার বিরক্তি-তিরস্কার লাভ করে । একদিন সন্ধ্যাবেলায় রমেশ বালিকার খোপা ধরিয়া নাড়া দিয়া কহিল, “সুশীলা, আজ তোমার চুলবাধা ভালো হয় নাই ।” বালিকা বলিয়া বসিল, “আচ্ছা, তোমরা সকলেই আমাকে সুশীলা বলিয়া ডাক কেন ?” রমেশ এ প্রশ্নের তাৎপর্য কিছুই বুঝতে না পারিয়া অবাক হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। বধু কহিল, “আমার নাম বদল হইলেই কি আমার পয় ফিরিবে ? আমি তো শিশুকাল হইতেই অপয়মন্ত— ন মরিলে আমার অলক্ষণ ঘুচিবে না।” হঠাৎ রমেশের বুক ধক করিয়া উঠিল, তাহার মুখ পাগুবৰ্ণ হইয়া গেল— কোথায় কী-একটা প্ৰমাদ ঘটিয়াছে, এ সংশয় হঠাৎ তাহার মনে জাগিয়া উঠিল । রমেশ জিজ্ঞাসা করিল, “শিশুকাল হইতেই তুমি অপয়মন্ত কিসে হইলে ?” বধু কহিল, “আমার জন্মের পূর্বেই আমার বাবা মরিয়াছেন, আমাকে জন্মদান করিয়া তাহার ছয় মাসের মধ্যে আমার মা মারা গেছেন । মামার বাড়িতে অনেক কষ্টে ছিলাম । হঠাৎ শুনিলাম, কোথা হইতে আসিয়া তুমি আমাকে পছন্দ করিলে— দুই দিনের মধ্যেই বিবাহ হইয়া গেল, তার পরে দেখো, কী সব বিপদই ঘটিল ।” রমেশ নিশ্চল হইয়া তাকিয়ার উপরে শুইয়া পড়িল । আকাশে চাদ উঠিয়াছিল, তাহার জ্যোৎস্না কালি হইয়া গেল। রমেশের দ্বিতীয় প্রশ্ন করিতে ভয় হইতে লাগিল ৷ যতটুকু জানিয়া ফেলিয়াছে, সেটুকুকে সে প্ৰলাপ বলিয়া, স্বপ্ন বলিয়া সুদূরে ঠেলিয়া বাখিতে চায় । সংজ্ঞাপ্ৰাপ্ত মুছতের দীর্ঘশ্বাসের মতো গ্ৰীষ্মের দক্ষিণ-হাওয়া বহিতে লাগিল। জ্যোৎস্নালোকে নিদ্রাহীন কোকিল ডাকিতেছে— অদূরে নদীর ঘাটে বাধা নীেকার ছাদ হইতে মাঝিদের গান আকাশে ব্যাপ্ত হইতেছে। অনেকক্ষণ কোনো সাড়া না পাইয়া বধূ অতি ধীরে ধীরে রমেশকে স্পর্শ করিয়া কহিল, “ম্বুমাইতেছ?” রমেশ কহিল, “না ।” তাহার পরেও অনেকক্ষণ রমেশের আর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। বধু কখন আস্তে আস্তে ঘুমাইয়া পড়িল। রমেশ উঠিয়া বসিয়া তাহার নিদ্রিত মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। বিধাতা ইহার ললাটে যে গুপ্তলিখন লিখিয়া রাখিয়াছেন, তাহা আজও এই মুখে একটি আঁক কাটে নাই। এমন সৌন্দর্যের ভিতরে সেই ভীষণ পরিণাম কেমন করিয়া প্রচ্ছন্ন হইয়া বাস করিতেছে ;