পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SR SRO রবীন্দ্র-রচনাবলী অক্ষয় সূরের ভাষায় নিজের অব্যক্ত কথা বলিবার চেষ্টা করিতেছিল— কিন্তু সে ভাষা কাছে লাগিতেছিল আর-দুই জনের। দুই জনের হৃদয় সেই স্বরলহরীকে আশ্রয় করিয়া পরস্পরকে আঘাত-অভিঘাত করিতেছিল । জগতে কিছু আর অকিঞ্চিৎকর রহিল না। সব যেন মনোরম হইয় গেল। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যত মানুষ যত ভালোবাসিয়াছে, সমস্ত যেন দুটিমাত্র হৃদয়ে বিভক্ত হই, অনির্বচনীয় সুখে দুঃখে আকাঙক্ষায় আকুলতায় কম্পিত হইতে লাগিল । সেদিন মেঘের মধ্যে যেমন ফাঁক ছিল না, গানের মধ্যেও তেমনি হইয়া উঠিল । হেমনলিনী কেবল অনুনয় করিয়া বলিতে লাগিল, “অক্ষয়বাবু, থামিবেন না, আর-একটা গান, আর-একটা গান “ উৎসাহে এবং আবেগে অক্ষয়ের গান অবাধে উৎসারিত হইতে লাগিল। গানের সুর স্তরে স্ত? পুঞ্জীভূত হইল, যেন তাহা সূচিভেদ্য হইয়া উঠিল, যেন তাহার মধ্যে রহিয়া রহিয়া বিদ্যুৎ খেলিছে লাগিল— বেদনাতুর হৃদয় তাহার মধ্যে আচ্ছন্ন-আবৃত হইয়া রহিল । দিয়া নীরবে হেমনলিনীর মুখের দিকে একবার চাহিল। হেমনলিনীও চকিতের মতো একবার চাহিল, তাহার দৃষ্টির উপরেও গানের ছায়া । রমেশ বাড়ি গেল ! বৃষ্টি ক্ষণকালমাত্র থামিয়াছিল, আবার বুপকূপ শব্দে বৃষ্টি পড়িতে লাগিল রমেশ সে রাত্রে ঘুমাইতে পারিল না | হেমনলিনীও অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া গভীর অন্ধকারের মধ্যে বৃষ্টিপতনের অবিরাম শব্দ শুনিতেছিল । তাহার কানে বাজিতেছিল— বায়ু বহী পুরবৈঞা, নীদ নহিঁ বিন সৈঞ । তাহার বদলে আমার অন্য অনেক বিদ্যা দান করিতে কুষ্ঠিত হইতাম না।” কিন্তু কোনো উপায়ে এবং কোনো কালেই সে যে গান গাহিতে পরিবে, এ ভরসা রমেশের ছিল না । সে স্থির করিল, “আমি বাজাইতে শিখিব।” ইতিপূর্বে একদিন নির্জন অবকাশে সে অন্নদাবাবুল ঘরে বেহালাখানা লইয়া ছড়ির টান দিয়াছিল— সেই ছড়ির একটিমাত্র আঘাতে সরস্বতী এমন আর্তনাদ করিয়া উঠিয়ছিলেন যে, তাহার পক্ষে বেহালার চর্চা নিতান্ত নিষ্ঠুরতা হইবে বলিয়া সে আশা সে পরিত্যাগ করে । আজ সে ছোটো দেখিয়া একটা হরমোনিয়ম কিনিয়া আনিল । ঘরের মধ্যে দরজা বন্ধ করিয়া অতি সাবধানে অঙ্গুলিচালনা করিয়া এটুকু বুঝিল যে, আর যাই হােক, এ যস্ত্রের সহিষ্ণুতা বেহালার চেয়ে বেশি ; পরদিনে অন্নদাবাবুর বাড়ি যাইতেই হেমনলিনী রমেশকে কহিল, “আপনার ঘর হইতে কাল যে, হারমোনিয়মের শব্দ পাওয়া যাইতেছিল ।” রমেশ ভাবিয়ছিল, দরজা বন্ধ থাকিলেই ধরা পড়িবার আশঙ্কা নাই । কিন্তু এমন কান আছে যেখানে রমেশের অবরুদ্ধ ঘরের শব্দও সংবাদ লইয়া আসে । রমেশকে একটুকু লজ্জিত হইয়া কবুল করিতে হইল যে সে একটা হরমোনিয়ম কিনিয়া আনিয়াছে এবং বাজাইতে শেখে ইহাই তাহার ইচ্ছা । হেমনলিনী কহিল, “ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া নিজে কেন মিথ্যা চেষ্টা করিবেন । তাহার চেয়ে আপনি আমাদের এখানে অভ্যাস করুন— আমি যতটুকু জানি, সাহায্য করিতে পারিব।” রমেশ কহিল, “আমি কিন্তু নিতান্ত আনাড়ি, আমাকে লইয়া আপনার অনেক দুঃখভোগ করিতে হইবে ।” ক্রমশই প্রমাণ হইতে লাগিল, রমেশ যে নিজেকে আনাড়ি বলিয়া পরিচয় দিয়াছিল, তাহ নিতান্ত বিনয় নহে। এমন শিক্ষকের এত অযাচিত সহায়তা সত্ত্বেও সুরের জ্ঞান রমেশের মগজের মধ্যে প্রবেশ করিবার কোনো সন্ধি খুজিয়া পাইল না । সম্ভারণমূঢ় জলের মধ্যে পড়িয়া যেমন উম্মত্তের মতো হাত-পা টুড়িতে থাকে, রমেশ সংগীতের হাটুজলে তেমনিতরো ব্যবহার করিতে লাগিল । তাহার কোন আঙুল কখন কোথায় গিয়া পড়ে তাহার ঠিকানা নাই— পদে পদে ভুল সুর বাজে, কিন্তু রমেশের কানে তাহা