পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

੨b রবীন্দ্র-রচনাবলী কমলার স্বামী নলিনাক্ষ যে বাচিয়া আছেন, এ আশা আজ রমেশের মন হইতে একেবারে দূর হইল । সকালে রমেশের হাতে আরো অনেকগুলা চিঠি আসিয়া পড়িল । বিবাহের সংবাদ পাইয়া তাহার আলাপী পরিচিত অনেকে তাহাকে অভিনন্দন-পত্ৰ লিখিয়াছে। কেহ-বা আহারের দাবি জানাইয়াছে, কেহ-বা। এত দিন সমস্ত ব্যাপারটা সে গোপন রাখিয়াছে বলিয়া রমেশকে সকৌতুক তিরস্কার করিয়াছে । এমন সময়ে অন্নদাবাবুর বাড়ি হইতে চাকর একখানি চিঠি লইয়া রমেশের হাতে দিল । হাতের অক্ষর দেখিয়া রমেশের বুকের ভিতরটা দুলিয়া উঠিল । হেমনলিনীর চিঠি । রমেশ মনে করিল, অক্ষয়ের কথা শুনিয়া হেমনলিনীর মনে সন্দেহ জন্মিয়াছে এবং তাঁহাই দূর করিবার জন্য সে রমেশকে পত্র লিখিয়াছে। চিঠি খুলিয়া দেখিল, তাহাতে কেবল এই ক'টি কথা লেখা আছে— “অক্ষয়বাবু কাল আপনার উপর ভারি অন্যায় করিয়াছেন । মনে করিয়াছিলাম আজ সকালেই আপনি আসিবেন, কেন আসিলেন না ? অক্ষয়বাবুর কথা কেন আপনি এত করিয়া মনে লাইতেছেন ? আপনি তো জানেন, আমি তার কথা গ্রাহ্যই করি না । আপনি আজ সকাল-সকাল আসিবেন- আমি আজ সেলাই ফেলিয়া রাখিব ।” এই ক'টি কথার মধ্যে হেমনলিনীর সাত্মনাসুধাপূর্ণ কোমল হৃদয়ের ব্যথা অনুভব করিয়া রমেশের চোখে জল আসিল । রমেশ বুঝিল, কাল হইতেই হেমনলিনী রমেশের বেদনা শান্ত করিবার জন্য ব্যগ্রহৃদয়ে প্রতীক্ষা করিয়া আছে । এমনি করিয়া রাত গিয়াছে, এমনি করিয়া সকালটা কাটিয়াছে, অবশেষে আর থাকিতে না পারিয়া এই চিঠিখনি লিখিয়াছে । রমেশ কাল হইতে ভাবিতেছে, আর বিলম্ব না করিয়া এইবার হেমনলিনীকে সকল কথা খুলিয়া বলা আবশ্যক হইয়াছে । কিন্তু কলাকার ব্যাপারের পর বলা কঠিন হইয়া উঠিয়াছে । এখন ঠিক শুনাইবে যেন অপরাধ ধরা পড়িয়া জবাবদিহির চেষ্টা হইতেছে। শুধু তাহাই নহে, অক্ষয়ের যে কতকটা জয় হইবে, সেও অসহ্য । রমেশ ভাবিতে লাগিল, কমলার স্বামী যে আর-কোনো রমেশ নিশ্চয়ই অক্ষয়ের মনে সেই ধারণাই আছে- নহিলে সে এতক্ষণে কেবল ইঙ্গিত করিয়া থামিয়া থাকিত না, পাড়াসুদ্ধ গোল করিয়া বেড়াইত । অতএব এই বেলা যাহা-হয় একটা উপায় অবলম্বন করা দরকার । এমন সময় আর-একটা ডাকের চিঠি আসিল । রমেশ খুলিয়া দেখিল, সে চিঠি স্ত্রীবিদ্যালয়ের অবস্থায় ছুটির সময় বিদ্যালয়ের বোর্ডিঙে রাখা তিনি সংগত বোধ করেন না । আগামী শনিবারে ইস্কুল হইয়া ছুটি হইবে, সেই সময়ে তাহাকে বিদ্যালয় হইতে বাড়ি লইয়া যাইবার ব্যবস্থা করা নিতান্ত আবশ্যক । আগামী শনিবারে কমলাকে বিদ্যালয় হইতে লইয়া আসিতে হইবে । আগামী রবিবারে রমেশের বিবাহ । “রমেশবাবু, আমাকে মাপ করিতে হইবে।” এই বলিয়া অক্ষয় ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। কহিল, “এমন একটা সামানা ঠাট্টায় আপনি যে এত রাগ করিবেন, তাহা আগে জানিলে আমি ও কথা তুলিতাম না । ঠাট্টার মধ্যে কিছু সত্য থাকিলেই লোকে চটিয়া ওঠে, কিন্তু যাহা একেবারে অমূলক তাহা লইয়া। আপনি সকলের সাক্ষাতে এত রাগারগি করিলেন কেন ? অন্নদাবাবু তো কাল হইতে আমাকে ভৎসনা করিতেছেন- হেমনলিনী আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করিয়াছেন । আজ সকালে তঁহাদের ওখানে গিয়াছিলাম, তিনি ঘর ছাডিয়া চলিয়াই গেলেন । আমি এমন কী অপরাধ করিয়াছিলাম বলুন দেখি ।” রমেশ কহিল, “এ-সমস্ত বিচার যথাসময়ে হইবে । এখন আমাকে মাপ করবেন- আমার বিশেষ