পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডুবি SOS না। আমিও অন্তর্যামীকে অন্তরে সাক্ষী রাখিয়া বলিতেছি তোমার কাছে আমি কখনো অবিশ্বাসী হইব। " রমেশের আর কথা বাহির হইল না, তাহার চোখের প্রান্তে জল দেখা দিল। তখন হেমনলিনী তাহার স্নিগ্ধকরুণ দুই চক্ষু তুলিয়া রমেশের মুখের দিকে স্থির করিয়া রাখিল । তাহার পরে সহসা বিগলিত অশ্রুধারা হেমনলিনীর দুই কপোল বাহিয়া ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে সেই নেতৃত বাতায়নতলে দুই জনের মধ্যে একটি বাক্যবিহীন শান্তি ও সাত্মনার স্বৰ্গখণ্ড সৃজিত হইয়া গেল। কিছুক্ষণ এই অশ্রুজলপ্লাবিত সুগভীর মীেনের মধ্যে হৃদয়মন নিমগ্ন রাখিয়া একটি আরামের দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া রমেশ কহিল, “কেন আমি এখন সপ্তাহের জন্য বিবাহ স্থগিত রাখিবার প্রস্তাব করিয়াছি, তাহার কারণ কি তুমি জানিতে চাও ?" হেমনলিনী নীরবে মাথা নাড়িল- সে জানিতে চায় না । রমেশ কহিল, “বিবাহের পরে আমি তোমাকে সব কথা খুলিয়া বলিব ।” এই কথাটায় হেমনলিনীর কাপোলের কাছটা একটুখানি রাঙা হইয়া উঠিল। আজ আহারান্তে হেমনলিনী যখন রমেশের সহিত মিলনপ্ৰত্যাশায় উৎসুকচিত্তে সাজ করিতেছিল, তখন সে অনেক হাসিগল্প, অনেক নিভৃত পরামর্শ, অনেক ছােটােখাটাে সুখের ছবি কল্পনায় সৃজন করিয়া লইতেছিল। কিন্তু এই-যে অল্প কয় মুহূর্তে দুই হৃদয়ের মধ্যে বিশ্বাসের মালা-বদল হইয়া গেল- এই-যে চোখের জল ঝরিয়া পড়িল, কথাবার্তা কিছুই হইল না, কিছুক্ষণের জন্য দুইজনে পাশাপাশি দাড়াইয়া রহিল— ইহার নিবিড় আনন্দ, ইহার গভীর শান্তি, ইহার পরম আশ্বাস সে কল্পনাও করিতে পারে নাই । হেমনলিনী কহিল, “তুমি একবার বাবার কাছে যাও, তিনি বিরক্ত হইয়া আছেন।” রমেশ প্রফুল্লচিত্তে সংসারের ছােটাে-বড়ো আঘাত-সংঘাত বুক পাতিয়া লইবার জন্য চলিয়া গেল । SG শুরুত্ব দেশকে পুনরায় গৃহে প্রবেশ করিতে দেখিয়া উদবিগ্নভাবে তাহার মুখের দিকে 密 রমেশ কহিল, “নিমন্ত্রণের ফর্দটা যদি আমার হাতে দেন, তবে দিনপরিবর্তনের চিঠিগুলি আজই রওনা করিয়া দিতে পারি।” অন্নদাবাবু কহিলেন, “তবে দিনপরিবর্তনই স্থির রহিল ?” রমেশ কহিল, “হা, অন্য উপায় আর কিছুই দেখি না।” অন্নদাবাবু কহিলেন, “দেখাে বাপু, তবে আমি ইহার মধ্যে নাই। যাহা-কিছু বন্দােবস্ত করিবার, সে তুমিই করিয়ো । আমি লোক হাসাইতে পারিব না। বিবাহ-ব্যাপারটাকে যদি নিজের মর্জি অনুসারে ছেলেখেলা করিয়া তোল, তবে আমার মতো বয়সের লোকের ইহার মধ্যে না থাকাই ভালো । এই লও তোমার নিমন্ত্রণের ফর্দ । ইতিমধ্যে আমি কতকগুলা টাকা খরচ করিয়া ফেলিয়াছি, তাহার অনেকটাই নষ্ট হইবে । এমনি করিয়া বার বার টাকা জলে ফেলিয়া দিতে পারি এমন সংগতি আমার নাই ।” রমেশ সমস্ত ব্যয় ও ব্যবস্থার ভার নিজের স্কন্ধে লইতেই প্ৰস্তুত হইল। সে উঠিবার উপক্রম করিতেছে, এমন সময় অন্নদাবাবু কহিলেন, “রমেশ, বিবাহের পরে তুমি কোথায় প্র্যাকটিস করিবে, কিছু স্থির করিয়াছ ? কলিকাতায় নয় ?” 资 রমেশ কহিল, “না। পশ্চিমে একটা ভালো জায়গার সন্ধান করিতেছি ।” অন্নদা । সেই ভালো, পশ্চিমই ভালো | এটোয়া তো মন্দ জায়গা নয় । সেখানকার জল হজমের পক্ষে অতি উত্তম- আমি সেখানে মাসখানেক ছিলাম- সেই এক মাসে আমার আহারের পরিমাণ ডবল বাড়িয়া গিয়াছিল। দেখো বাপু, সংসারে আমার ঐ একটিমাত্র মেয়ে- আমি সর্বদা উহার কাছে