পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডুবি S(፩(h ভাজাইয় তাহার দৈত্যকে দিয়া সওগাদ পঠাইয়াছে তখন কমলার আর ধৈর্য কিছুতেই রহিল না ; সে মুখ ফিরাইয়া কহিল, "তবে যাও আমি বলিব না।" রমেশ বাস্ত হইয়া কহিল, “না, না, আমি হার মানিতেছি । মাঝদরিয়ায় লুচি, এ যে কেমন করিয়া সম্ভব হইতে পারে, আমি তো ভাবিয়া পাইতেছি না, কিন্তু তবু খাইতে চমৎকার লাগিতেছে।" এই বলিয়া রমেশ তত্ত্বনির্ণয় অপেক্ষা ক্ষুধানিবৃত্তির শ্রেষ্ঠতা সবেগে সপ্রমাণ করিতে লাগিল। স্টীমার চরে ঠেকিয়া গেলে, শূন্যভাণ্ডারপূরণের চেষ্টায় কমলা উমেশকে গ্রামে পঠাইয়াছিল। স্কুলে থাকিতে জলপানি-স্বরূপে রমেশ কমলাকে যে কয়টি টাকা দিয়াছিল, তাহারই মধ্য হইতে অল্প কিছু বঢ়িয়ছিল, তাঁহাই দিয়া কিছু ঘি-ময়দা সংগ্ৰহ হইল। উমেশকে কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “উমেশ, তুই কী খাবি বল দেখি।” উমেশ কহিল, “মােঠাকরুন, দয়া কর যদি, গ্রামে গোয়ালার বাড়িতে বড়ো সরেস দই দেখিয়া আসিলাম। কলা তো ঘরেই আছে, আর পয়সা-দুয়েকের চিড়ে-মুড়কি হইলেই পেট ভরিয়া আৰ্জ ফলার করিয়া লই ।” লুব্ধ বালকের ফলারের উৎসাহে কমলাও উৎসাহিত হইয়া উঠিল ; কহিল, "পয়সা কিছু বাচিয়াছে উমেশ ?” উমেশ কহিল, “কিছু না মা ।” কমলা মুশকিলে পড়িয়া গেল। রমেশের কাছে কেমন করিয়া মুখ ফুটিয়া টাকা চাহিবে, তাই ভাবিতে লাগিল। একটু পরে বলিল, “তোর ভাগে আজ যদি ফলার নাই জোটে, তবে লুচি আছে— তোর ভাবনা নাই। চল, ময়দা মাখবি চলা।" উমেশ কহিল, “কিন্তু মা, দই যা দেখিয়া আসিলাম সে আর কী বলিব ।” কমলা কহিল, “দেখ উমেশ বাবু যখন খাইতে বসিবেন তখন তুই তোর বাজারের পয়সা চাইতে আসিস ।” রমেশের আহার কতকটা অগ্রসর হইলে, উমেশ আসিয়া দাড়াইয়া সসংকোচে মাথা চুলকাইতে লাগিল। রমেশ তাহার মুখের দিকে চাহিল। সে অর্ধ্যেক্তিতে কহিল, “মা, বাজারের পয়সা—” তখন রমেশের হঠাৎ চেতনা হইল যে, আহারের আয়োজন করিতে হইলে অর্থের প্রয়োজন হয়, আলাদীনের প্রদীপের অপেক্ষা করিলে চলে না। ব্যস্ত হইয়া কহিল, “কমলা, তোমার কাছে তো টাকা কিছুই নাই। আমাকে মনে করাইয়া দাও নাই কেন ?” কমলা নীরবে অপরাধ স্বীকার করিয়া লইল । আহারান্তে রমেশ কমলার হাতে একটি ছোটো ক্যাশবাক্স দিয়া কহিল, “এখনকার মতো তোমার ধনরত্ন সব এইটােতেই রহিল।" এইরূপে গৃহিণীপনার সমস্ত ভারই আপনা হইতেই কমলার হাতে গিয়া পড়িতেছে, রমেশ তাহা প্রত্যক্ষ করিয়া আবার একবার জাহাজের রেলিং ধরিয়া পশ্চিম আকাশের দিকে চাহিল। পশ্চিম আকাশ দেখিতে দেখিতে তাহার চোখের উপরে সম্পূর্ণ অন্ধকার হইয়া আসিল । উমেশ আজ পেট ভরিয়া চড়ে দই কলা মাখিয়া ফলার করিল। কমলা সম্মুখে দাড়াইয়া তাহার জীবনবৃত্তান্ত সবিস্তারে আয়ত্ত করিয়া লইল । | বিমাতা-শাসিত গৃহের উপেক্ষিত উমেশ কাশীতে তাহার মাতামহীর কাছে পালাইয়া যাইতেছিল ; সে কহিল, “মা, যদি তোমাদের কাছেই রােখ তবে আমি আর কোথাও যাই না।” মাতৃহীন বালকের মুখে মা-সম্ভাষণ শুনিয়া বালিকার কোমল হৃদয়ের কোন-এক গভীরদেশ হইতে জননী সাড়া দিল ; কমলা স্নিগ্ধস্বরে কহিল, “বেশ তো উমেশ, তুই আমাদের সঙ্গেই চল ।”