পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডবি RVU) কমলা বাহির হইয়া গিয়া কহিল, “উহাকে ফেলিয়া যাইতে পরিবে না- একটু থামাও । ও আমাদের উমেশ ।” রমেশ তখন নিয়মলঙ্ঘন ও আপত্তিভঞ্জনের সহজ উপায় অবলম্বন করিল। পুরস্কারের আশ্বাসে সারেং জাহাজ থামাইয়া উমেশকে তুলিয়া লইয়া তাহার প্রতি বহুতর ভৎসনা প্রয়োগ করিতে লাগিল । সে তাঁহাতে ভুক্ষেপমাত্র না করিয়া কমলার পায়ের কাছে বুড়িটা নামাইয়া, যেন কিছুই হয় নাই এমনি ভাবে হাসিতে লাগিল । কমলার তখনো বক্ষের ক্ষোভ দূর হয় নাই। সে কহিল, “হাসছিস যে ! জাহাজ যদি না থামিত তবে তোর কী হইত ?” উমেশ তাহার স্পষ্ট উত্তর না করিয়া বুড়িটা উজাড় করিয়া দিল। এক কাদি কঁচকলা, কয়েক রকম শাক, কুমড়ার ফুল ও বেগুন বাহির হইয়া পড়িল । কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “এ-সমস্ত কোথা হইতে আনিলি ?” উমেশ সংগ্রহের যাহা ইতিহাস দিল তাহা কিছুমাত্র সন্তোষজনক নহে। গতকল্য বাজার হইতে দধি প্রভৃতি কিনিতে যাইবার সময় সে গ্রামস্থ কাহারও বা চালে কাহারও বা খেতে এই সমস্ত ভোজ্যপদার্থ লক্ষ্য করিয়াছিল। আজ ভোরে জাহাজ ছাড়িবার পূর্বে তীরে নামিয়া এইগুলি যথাস্থান হইতে চয়ন-নির্বাচনে প্রবৃত্ত হইয়াছিল, কাহারও সম্মতির অপেক্ষা রাখে নাই। রমেশ অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, “পরের খেত হইতে তুই এই সমস্ত চুরি করিয়া আনিয়াছিস ?” উমেশ কহিল, "চুরি করিব কেন ? খেতে কত ছিল, আমি অল্প এই কাটি আনিয়াছি বৈ তো নয়, ইহাতে ক্ষতি কী হইয়াছে ?” রমেশ । অল্প আনিলে চুরি হয় না ? লক্ষ্মীছাড়া ! যা, এ-সমস্ত এখান থেকে লইয়া যা উমেশ করুণনেত্রে একবার কমলার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “মা, এইগুলিকে আমাদের দেশে পিড়িং। শাক বলে, ইহার চচ্চড়ি বড়ো সরেস হয়। আর এইগুলো বেতো শাক-” প্রমাণু বিরক্ত ইয়া কহিল, "নেিয় যা তাের পড়াশক। নহলে আহি সমস্ত লীর জলে " এ সম্বন্ধে কর্তব্যনিরূপণের জন্য সে কমলার মুখের দিকে চাহিল। কমলা লইয়া যাইবার জন্য সংকেত করিল । সেই সংকেতের মধ্যে করুণামিশ্ৰিত গোপন প্ৰসন্নতা দেখিয়া উমেশ শাকসবজিগুলি কুড়াইয়া চুপড়ির মধ্যে লইয়া ধীরে ধীরে প্রস্থান করিল। রমেশ কহিল, “এ ভারি অন্যায়। ছেলেটাকে তুমি প্রশ্রয় দিয়ে না।” রমেশ চিঠিপত্র লিখিবার জন্য তাহার কামরায় চলিয়া গেল। কমলা মুখ বাড়াইয়া দেখিল, সেকেণ্ডফ্লাসের ডেক পারাইয়া জাহাজের হালের দিকে যেখানে তাঁহাদের দরমা-ঢাকা রান্নার স্থান নির্দিষ্ট হইয়াছে সেইখানে উমেশ চুপ করিয়া বসিয়া আছে। সেকেণ্ডফ্লাসে যাত্রী কেহ ছিল না। কমলা মাথায় গায়ে একটা র্যাপার জড়াইয়া উমেশের কাছে গিয়া কহিল, “সেগুলো সব ফেলিয়া দিয়াছিস নাকি ?” উমেশ কহিল, “ফেলিতে যাইব কেন ? এই ঘরের মধ্যেই সব রাখিয়াছি।” কমলা রাগিব।ার চেষ্টা করিয়া কহিল, “কিন্তু তুই ভারি অন্যায় করিয়াছিস । আর কখনো এমন কাজ করিস নে। দেখ দেখি স্টীমার যদি চলিয়া যাইত !” এই বলিয়া ঘরের মধ্যে গিয়া কমলা উদ্ধতস্বরে কহিল, “আন, বঁটি আন।” উমেশ বঁটি আনিয়া দিল। কমলা সবেগে উমেশের আহৃত তরকারি কুটিতে প্ৰবৃত্ত হইল। উমেশ । মা, এই শাকগুলার সঙ্গে সৰ্যেবাটা খুব চমৎকার হয়। কমলা ক্রুদ্ধস্বরে কহিল, “আচ্ছ, তবে সর্ষে বাট ।” এমনি করিয়া উমেশ যাহাতে প্রশ্রয় না পায়, কমলা সেই সতর্কতা অবলম্বন করিল। বিশেষ