পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডবি ୯୯୩ A. দুই শ্ৰান্ত চক্ষু ঘুমে বুজিয়া আসিল। প্রভাতের রৌদ্র যখন তাহার ঘরের দ্বারে করাঘাত করিল। তখনাে সে নিদ্রায় মগ্ন । ՀԵ শ্ৰান্তির মধ্যে পরের দিন কমলার দিবসারম্ভ হইল। সেদিন তাহার চক্ষে সূর্যের আলোক ক্লান্ত, নদীর ধারা ক্লান্ত, তীরের তরুগুলি বহুদূরপথের পথিকের মতো ক্লান্ত । উমেশ যখন তাহার কাজে সহায়তা করিতে আসিল কমলা শ্ৰান্তকণ্ঠে কহিল, “যা উমেশ, আমাকে আজ আর বিরক্ত করিস নে ৷” উমেশ অল্পে ক্ষান্ত হইবার ছেলে নহে। সে কহিল, “বিরক্ত করিব কেন মা, বাটনা বাটিতে আসিয়াছি।” সকালবেলা রমেশ কমলার চোখমুখের ভাব দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, “কমলা, তোমার কি অসুখ করিয়াছে ?” এরূপ প্রশ্ন যে কতখানি অনাবশ্যক ও অসংগত, কমলা কেবল তাহা একবার প্রবল গ্ৰীবা-আন্দোলনের দ্বারা নিরুত্তরে প্রকাশ করিয়া রান্নাঘরের দিকে চলিয়া গেল । রমেশ বুঝিল, সমস্যা ক্রমশ প্রতিদিনই কঠিন হইয়া আসিতেছে। অতিশীঘ্রই ইহার একটা শেষ মীমাংসা হওয়া আবশ্যক। হেমনলিনীর সঙ্গে একবার স্পষ্ট বােঝাপড়া হইয়া গেলে কর্তব্যনির্ধারণ সহজ হইবে, ইহা রমেশ মনে মনে আলোচনা করিয়া দেখিল । অনেক চিন্তার পর হেমকে চিঠি লিখিতে বসিল । একবার লিখিতেছে, একবার কাটিতেছে, এমন সময় “মহাশয়, আপনার নাম ?” শুনিয়া চমকিয়া মুখ তুলিল। দেখিল, একটি প্রৌঢ়বয়স্ক ভদ্রলোক পাকা গোফ ও মাথার সামনের দিকটায় পাতলা চুলেটাকের আভাস লইয়া সম্মুখে উপস্থিত। রমেশের একান্তনিবিষ্ট চিত্তের মনোযোগ চিঠির চিন্তা হইতে অকস্মাৎ উৎপাটিত হইয়া ক্ষণকালের জন্য বিভ্রান্ত হইয়া রহিল । "আপনি ব্ৰাহ্মণ ? নমস্কার । আপনার নাম রমেশবাবু, সে আমি পূর্বেই খবর লইয়াছি- তবু দেখুন আমাদের দেশে নাম-জিজ্ঞাসাটা পরিচয়ের একটা প্ৰণালী । ওটা ভদ্রতা । আজকাল কেহ কেহ ইহাতে রাগ করেন। আপনি যদি রাগ করিয়া থাকেন তো শোধ তুলুন। আমাকে জিজ্ঞাসা করুন, আমি নিজের নাম বলিব, বাপের নাম বলিব, পিতামহের নাম বলিতে আপত্তি করিব না।” সুপ্রিয় হলে আমরা এত বেশ আন্সেল অপর একার বর্ষপঞ্জী অৰ হইব ।” “আমার নাম ত্ৰৈলোক্য চক্রবর্তী। পশ্চিমে সকলেই আমাকে ‘খুড়ো” বলিয়া জানে। আপনি তো চক্রবর্তী-খুড়ো। যখন পশ্চিমে যাইতেছেন তখন আমার পরিচয় আপনার অগোচর থাকিবে না। কিন্তু মহাশয়ের কোথায় যাওয়া হইতেছে ?” রমেশ কহিল, “এখনো ঠিক করিয়া উঠিতে পারি নাই ।” ত্ৰৈলোক্য। আপনার ঠিক করিয়া উঠিতে বিলম্ব হয়, কিন্তু জাহাজে উঠিতে তো দেরি সহে নাই । রমেশ কহিল, “একদিন গোয়ালন্দে নামিয়া দেখিলাম, জাহাজে বঁাশি দিয়াছে। তখন এটা বেশ বোঝা গেল, আমার মন স্থির করিতে যদি বা দেরি থাকে। কিন্তু জাহাজ ছড়িতে দেরি নাই। সুতরাং ত্ৰৈলোক্য। নমস্কার মহাশয়। আপনার প্রতি আমার ভক্তি হইতেছে। আমাদের সঙ্গে আপনার অনেক প্রভেদ । আমরা আগে মতি স্থির করি, তাহার পরে জাহাজে চড়ি- কারণ আমরা অত্যন্ত ভীরুস্বভাব। আপনি যাইবেন এটা স্থির করিয়াছেন, অথচ কোথায় যাইবেন কিছুই স্থির করেন নাই, এ কি কম কথা ! পরিবার সঙ্গেই আছেন ? კr