পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२१० 障 রবীন্দ্র-রচনাবলী এই প্রতিদিনের আনন্দিত গৃহিণীপনাকে যেন সোনার জলের ছবির মাঝখানে এক-একটি সরল কবিতার পৃষ্ঠার মতো উলটাইয়া যাইতে লাগিল । কর্মের উৎসাহে দিন আরম্ভ হইত। উমেশ আজকাল আর স্টীমার ফেল করে না, কিন্তু তাহার বুড়ি ভর্তি হইয়া আসে। ক্ষুদ্র ঘরকন্নার মধ্যে উমেশের এই সকালবেলাকার বুড়িটা পরম কৌতুহলের বিষয়। 'এ কী রে, এ যে লাউডগা ! ওমা, শজনের খাড়া তুই কোথা হইতে জোগাড় করিয়া আনিলি ? এই দেখো দেখো, খুড়োমশায়, টক-পালং যে এই খোট্টার দেশে পাওয়া যায় তাহা তো আমি জনিতাম না।" বুড়ি লইয়া রোজ সকালে এইরূপ একটা কলরব উঠে। যেদিন রমেশ উপস্থিত থাকে সেদিন ইহার মধ্যে একটু বেসুর লাগে— সে চৌর্য সন্দেহ না করিয়া থাকিতে পারে না । কমলা উত্তেজিত হইয়া বলে, “বাঃ, আমি নিজের হাতে উহাকে পয়সা গনিয়া দিয়াছি।” রমেশ বলে, “তাহাতে উহার চুরির সুবিধা ঠিক দ্বিগুণ বাড়িয়া যায়। পয়সাটাও চুরি করে, শাকও চুরি, করে।” এই বলিয়া রমেশ উমেশকে ডাকিয়া বলে, “আচ্ছা, হিসাব দে দেখি ।” তাহাতে তাহার এক বারের হিসাবের সঙ্গে আর-এক বারের হিসাব মেলে না । ঠিক দিতে গেলে জমার চেয়ে খরচের অঙ্ক বেশি হইয়া.উঠে । ইহাতে উমেশ লেশমাত্র কুষ্ঠিত হয় না। সে বলে, “আমি যদি হিসাব ঠিক রাখিতে পারিব তবে আমার এমন দশা হইবে কেন ? আমি তো গোমস্ত হইতে পরিতাম, কী বলেন দাদাঠাকুর ?” চক্রবর্তী বলেন, “রমেশবাবু, আহারের পর আপনি উহার বিচার করবেন, তাহা হইলে সুবিচার করিতে পরিবেন। আপাতত আমি এই ছোড়াটাকে উৎসাহ না দিয়া থাকিতে পারিতেছি না। উমেশ, বাবা, সংগ্ৰহ করার বিদ্যা কম বিদ্যা নয় ; অল্প লোকেই পারে। চেষ্টা সকলেই করে ; কৃতকাৰ্য কয়জনে হয় ? রমেশবাবু, গুণীর মর্যাদা আমি বুঝি । শজনে-খাড়ার সময় এ নয়, তবু এত ভোরে বিদেশে শজনের খাড়া কয়জন ছেলে জোগাড় করিয়া আনিতে পারে বলুন দেখি । মশায়, সন্দেহ করিতে অনেকেই পারে ; কিন্তু সংগ্ৰহ করিতে হাজারে একজন পারে ।” রমেশ । খুড়ো, এটা ভালো হইতেছে না, উৎসাহ দিয়া অন্যায় করিতেছেন। চক্রবর্তী । ছেলেটার বিদ্যে বেশি নেই, যেটাও আছে সেটাও যদি উৎসাহের অভাবে নষ্ট হইয়া যায় তো বড়ো আক্ষেপের বিষয় হইবে- অন্তত যে কয়দিন আমরা স্টীমারে আছি। ওরে উমেশা, কাল কিছু নিমপাতা জোগাড় করিয়া আনিস ; যদি উচ্ছে পাস আরো ভালো হয়— মা, সুতুনিটা নিতান্তই চাই। আমাদের আয়ুর্বেদে বলে— থাক, আয়ুর্বেদের কথা থাক, এ দিকে বিলম্ব হইয়া যাইতেছে। উমেশ, শাকগুলো বেশ করে ধুয়ে নিয়ে আয় । রমেশ এইরূপে উমেশকে লইয়া যতই সন্দেহ করে, খিটখিট করে, উমেশ ততই যেন কমলার বেশি করিয়া আপনার হইয়া উঠে । ইতিমধ্যে চক্রবর্তী তাহার পক্ষ লওয়াতে রমেশের সহিত কমলার দলটি যেন বেশ একটু স্বতন্ত্র হইয়া আসিল । রমেশ তাহার সূক্ষ্ম বিচারশক্তি লইয়া এক দিকে একা ; অন্য দিকে কমলা উমেশ এবং চক্রবর্তী তাঁহাদের কর্মসূত্রে, স্নেহসূত্রে, আমোদ-আহ্রদের সূত্রে ঘনিষ্ঠভাবে এক। চক্রবর্তী আসিয়া অবধি তাহার উৎসাহের সংক্ৰামক উত্তাপে রমেশ কমলাকে পূর্বাপেক্ষা বিশেষ ঔৎসুক্যের সহিত দেখিতেছে, কিন্তু তবু দলে মিশিতে পারিতেছে না। বড়ো জাহাজ যেমন ডাঙায় ভিড়িতে চায়, কিন্তু জল কম বলিয়া তাহাকে তফাতে নােঙর ফেলিয়া দূর হইতে তাকাইয়া থাকিতে হয়, এ দিকে ছোটাে ছোটাে ডিঙি-পানসিগুলো অনায়াসেই তীরে গিয়া ভিড়ে, রমেশের সেই দশা হইয়াছে । পূৰ্ণিমার কাছাকাছি একদিন সকালে উঠিয়া দেখা গেল, রাশি রাশি কালো মেঘ দলে দলে আকাশ পূৰ্ণ করিয়া ফেলিয়াছে। বাতাস এলোমেলো বহিতেছে। বৃষ্টি এক-এক বার আসিতেছে, আবার এক-এক বার ধরিয়া গিয়া রৌদ্রের আভাসও দেখা যাইতেছে। মাঝগঙ্গায় আজ আর নৌকা নাই, দু-একখানা যা দেখা যাইতেছে তাহাদের উৎকণ্ঠিত ভােব স্পষ্টই বুঝা যায়। জলাথিনী মেয়েরা আজ